ভোটে দিকে দিকে জোড়া ফুল ফুটতে দেখে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন সবাই! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক সিদ্ধান্তের জেরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেই না সমর্থন চেয়ে রাহুল গাঁধী থেকে সীতারাম ইয়েচুরিকে ফোন করলেন এবং সটান দিল্লি গিয়ে হইচই শুরু করে দিলেন, আবার মনে পড়ে গেল সকলের!
দ্রুত তাই বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে সারদা-সহ বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিতদের টাকা ফেরত ও বিচারের দাবিতে ফের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়ছে বিরোধীরা।
অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারী ও এজেন্টদের নানা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় রেখে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান, সিপিএমের সুজন ও শ্যামল চক্রবর্তী, আইনজীবী-নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যেরা। নোট বাতিলের ঘটনায় তৃণমূল নেত্রীর ‘অতি-সক্রিয়তা’ দেখে তাঁরাই আবার সক্রিয় হয়েছেন। নানা সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে আগামী সোমবার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল করবেন মান্নান-সুজনেরা। প্রতারিতদের জন্য টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হাইকোর্ট কমিটি গড়ে দেওয়ার পরেও রাজ্য সরকারের হেলদোল নেই কেন, সেই প্রশ্নই তোলা হবে রাজপথ থেকে। যদিও তৃণমূলের দাবি, নোট-কাণ্ডের জেরে যে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সারদা-নারদাকে এক করে দেখা উচিত নয়। তাদের যুক্তি, বিধানসভা ভোটের সঙ্গেই সারদা-নারদারও সমাধি হয়েছে!
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে পাশে নিয়ে মমতা যখন মোদীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে ব্যস্ত, তখন তাঁকে অর্থলগ্নি সংস্থার কালো টাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজনবাবু। তিনি শুক্রবার বলেন, ‘‘কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযানের উনি নাকি সমর্থক।
আর এখানে যারা কালো টাকার আড়তদার, তাদের সঙ্গেই ডেলোর বাংলায় বৈঠক করেছিলেন! উনি কালো টাকার বিরুদ্ধে বলবেন আর বললেই লোকে বিশ্বাস করবে?’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজনবাবুর আরও বক্তব্য, মমতা মুখে বলছেন তিনি মানুষের হয়রানির প্রতিবাদ করছেন। তা হলে গরিব মানুষের জন্যই হাইকোর্টের গড়া কমিটিকে মমতার সরকার কেন সহায়তা করছে না? পাশাপাশিই দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, সমবায় ব্যাঙ্ক ও সমিতিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে নোট বদলের জন্য ব্যবহারের দাবিতে ‘ইতিবাচক’ আন্দোলনও করতে হবে পথে নেমে। আম জনতার সহায়তায় দলের তরফে খোলা হবে আরও বেশি হেল্প ডেস্কও।
বাম-কংগ্রেস যখন রাস্তায় নামার প্রস্ততি নিচ্ছে, মমতার দলকে বিঁধে ফেলার সুযোগ তখন হাতছাড়া করছে না বিজেপি-ও। সারদা-কাণ্ডে ‘ভাগ মমতা ভাগ’ স্লোগান দিয়ে যিনি হইচই ফেলেছিলেন, বিজেপি-র সেই নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলছেন, ‘‘মমতা চাইলে বারাণসীতে আসতেই পারেন। আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন।’’ তবে দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার মন্তব্য, ‘‘আমরা চাই, উনি বারাণসী (মোদীর লোকসভা কেন্দ্র) আসুন। আর একটা অণ্ণা হজারে পর্ব হবে!’’
বস্তুত, তৃণমূল নেত্রী তাঁর নিজের ঘরের লোকজনের বিপদ আঁচ করেই পুরনো নোট চালু রাখতে এত মরিয়া হয়েছেন— এমন ছবিই তুলে ধরতে চাইছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘খেলনা ভেঙে গেলে বাচ্চার চিৎকার করে, মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, রেগে গিয়ে নিজের চুলও ছেঁড়ে। ওঁর টাকা হারানোর দুঃখে মমতা তা-ই করছেন!’’ দলের নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘কার্তিক-গণেশ, এই রকম নানা ধরনের লোকেদের কালো টাকা আছে। এই সিদ্ধান্তে ভিখিরি হচ্ছে তারাই! সাধারণ মানুষের অসুবিধা হচ্ছে না।’’ আর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের টুইট, ‘‘দিদি এখনও কেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন? ওঁর ইচ্ছায় মোদী কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই থেকে সরে আসবেন? এটা তো অলীক কল্পনা!’’
বিরোধীরা বলছে, কয়েকটি অর্থলগ্নি সংস্থায় প্রতারিত মানুষের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে একটি কমিটি হয়েছিল। তার পরে সুপ্রিম কোর্টে ইডি-র আবেদন খারিজ হওয়ায় হাইকোর্টের সিদ্ধান্তই বহাল আছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে তাদের কোনও পরিকাঠামোগত সহযোগিতাও করা হচ্ছে না বলে আদালতে জানিয়েছে কমিটি। আর যে সব সংস্থা এখনও মামলার আওতাধীন নয়, তাদের ক্ষেত্রে মমতার সরকারের নিজের আইনেই টাকা ফেরানো যেতে পারে। সুজনবাবু যে কারণে বলেছেন, ‘‘দিল্লিতে যেটা করছেন, সেটা যে নাটক নয়, প্রমাণ করতে গেলে রাজ্যে এই কাজগুলো করতে হবে!’’ আর বিরোধী দলনেতা মান্নানের কথায়, ‘‘নিজের অসুবিধা হয়ে গেল বলেই হঠাৎ মোদীর উপরে চাপ সৃষ্টি করতে নেমে পড়লেন!’’
হঠাৎ আক্রমণের মুখে পড়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলছেন, ‘‘সারদা-নারদা দিয়ে গোটাদশেক নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। একটা ভোটেও তো বিরোধীরা মাটি ছুঁতে পারেনি! এখনও এ সব করে তৃণমূল নেত্রীর প্রতিবাদের স্বর দমানো যাবে না!’’ বিরোধীরা তবু নাছোড়!