ভুল হলে ধরাবেন অশোক, বলে গেলেন ‘ছোট বোন’

সচরাচর ভুলের কথা তাঁর মুখে শোনা যায় না। সেই তিনিই কি না তাঁর কাজে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এক অগ্রজ নেতার হাতে! তা-ও আবার তাঁর বিরোধী বাম শিবিরের বর্ষীয়ান নেতাকে! এমন বিরল ঘটনারই বৃহস্পতিবার সাক্ষী থাকল মধ্য কলকাতার হেমন্ত বসু ভবন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ১৫:১৬
Share:

একান্ত আলাপচারিতায় দুই নেতা।

সচরাচর ভুলের কথা তাঁর মুখে শোনা যায় না। সেই তিনিই কি না তাঁর কাজে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এক অগ্রজ নেতার হাতে! তা-ও আবার তাঁর বিরোধী বাম শিবিরের বর্ষীয়ান নেতাকে!

Advertisement

এমন বিরল ঘটনারই বৃহস্পতিবার সাক্ষী থাকল মধ্য কলকাতার হেমন্ত বসু ভবন। ফরওয়ার্ড ব্লকের সদর দফতরে গিয়ে প্রবীণতম বাম নেতা অশোক ঘোষকে প্রায় নিজের অভিভাবকের মর্যাদা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! সরকার চালাতে গিয়ে তাঁর ভুলভ্রান্তি দেখলে শুধরে দেওয়ার অধিকারও ফ ব-র রাজ্য সম্পাদককে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। গত সপ্তাহেই ছিল অশোকবাবুর ৯৪তম জন্মদিন। ধস-বিধ্বস্ত দার্জিলিং থেকে সে দিন ফোন করে অশোকবাবুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মমতা। সেই সঙ্গেই ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, কলকাতায় ফিরে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চান। সেই ইচ্ছাপূরণই হল বৃহস্পতিবারের বারবেলায়। নবান্ন যাওয়ার আগে ফ ব দফতরে গিয়ে প্রবীণ বাম নেতাকে ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদর এবং কেক-মিষ্টি-ফুল সহযোগে শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।


অশোক ঘোষের বাড়িতে পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

সৌজন্য সাক্ষাতের পরে দু’তরফেই সৌহার্দ্যের ছবি ছিল চোখে পড়ার মতো। অশোকবাবু বলেছেন, ‘‘মমতা আমার ছোট বোনের মতো। তিনি আমার কাছে এসেছেন বলে আমি খুব খুশি। আমার ছোট বোনের হাতে নেতাজির ছবি তুলে দিলাম। আমাদের মতো মমতাও নেতাজির আদর্শে অনুপ্রাণিত।’’ প্রবীণ নেতার হাসির রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘নেতাজির আদর্শ সকলকেই অনুপ্রাণিত করে। তা ছাড়া, কিছু বামপন্থী বন্ধুর সঙ্গে আমার আদর্শের কোনও তফাত নেই। এটা প্রগতিশীল আদর্শ। আমার নীতি মানুষের পক্ষে। আমি সর্বহারাদের পক্ষে।’’ একই সঙ্গে মমতা বলেছেন, ‘‘অশোকদা’র শতবর্ষ কামনা করি। উনি ভাল থাকুন, উপদেশ দিন। কোথাও কোনও ভুল-ত্রুটি হলে ধরিয়ে দিন। আমার কাজে ভুল হলে আপনি বলবেন, এটা আমি অশোকদা’কে বলে গেলাম।’’ এর পরেই নেতাজির ছবি হাতে নিয়ে দু’জনে মিলে ‘জয়হিন্দ’ স্লোগানেও গলা মিলিয়েছেন!

মমতা বারেবারেই দাবি করেছেন, তাঁর এই সাক্ষাৎ-পর্ব নিখাদ সৌজন্য। কিন্তু তৃণমূল-বিরোধী যৌথ মঞ্চ গড়ে ওঠা নিয়ে যখন বাম শিবিরে নানা রকম চর্চা চলছে, সেই সময়েই সৌজন্যের মোড়কে ফ ব দফতরে প্রায় ৫০ মিনিট কাটিয়ে মমতা আসলে আলিমুদ্দিনকেই সচেতন ভাবে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে বামফ্রন্টের একাংশের ব্যাখ্যা। ফ ব-রই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘মমতা কোনও কাজ উদ্দেশ্য ছাড়া করেন না। বামপন্থীদের একাংশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভাল, চাইলে তিনি বামফ্রন্টের মধ্যে ভাঙনও ধরাতে পারেন, এই রকম একটা বাতাবরণ তিনি সচেতন ভাবেই তৈরি করে রাখলেন!’’ বামপন্থী আর এক নেতার সরস মন্তব্য, ‘‘ফ ব-তে অশোকদা’র উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে লড়াই তো তীব্র। দেখে মনে হচ্ছে, নেতাজির ছবি মমতাকে দিয়ে অশোকদা যেন ভবিষ্যতে তাঁর দল চালানোর দায়িত্বটা তাঁকেই দিলেন!’’


অশোকবাবুকে নেতাজির ছবি উপহার মুখ্যমন্ত্রীর।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই ফ ব দফতরে হাজির ছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। অশোকবাবুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নরেন চট্টোপাধ্যায় ও বিধায়ক পরেশ অধিকারী (হয়তো সে কারণেই বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ‘নরেশবাবু’ সম্বোধন শোনা গিয়েছে)। বামফ্রন্টের মধ্যে ফ ব-র রাজ্য নেতৃত্বের তরফে ইদানীং যাঁরা সক্রিয়, সেই জয়ন্ত রায় বা হাফিজ আলম সৈরানি অবশ্য এই সাক্ষাৎ-পর্বের সময় দলের দফতরে হাজির হননি। ফ ব-র দফতরে একটি শৌচালয় দেখে তার দরজা কেন নেই, তার জন্য ওই দলের নেতাদের মৃদু ভর্ৎসনাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী! বৈঠকে রাজনৈতিক আলোচনা অবশ্য বিশেষ হয়নি। ছিটমহল নিয়ে চুক্তির মধ্যে আংড়াপোতা এবং দহগ্রাম যে বাদ পড়েছে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন কোচবিহারের নেতা পরেশবাবু। ‘নেতাজি সুভাষ ফাউন্ডেশনে’র বাড়ি সম্পূর্ণ করা নিয়েও দু’পক্ষের কথা হয়েছে। আর অশোকবাবু তাঁর ‘ছোট বোন’কে অনুরোধ করেছেন, নেতাজির জন্মদিনটা আগের মতো রাজ্য সরকার এবং নেতাজি জয়ন্তী কমিটি মিলে রেড রোডেই পালন করুক। কমিটি রেড রোডে আর রাজ্য সরকার দার্জিলিঙের পাহাড়ে— এই দৃশ্যটা ভাল লাগে না!


মুখ্যমন্ত্রী এবং ফরওয়ার্ড ব্লক রাজ্য সভাপতি অশোক ঘোষের সঙ্গে ছিলেন ফিরহাদ হাকিম, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রবীণতম নেতা হিসাবে অশোকবাবুই এখন ‘জ্যোতি বসু জন্মশতবর্ষ কমিটি’র সভাপতি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বৃহস্পতিবার জ্যোতিবাবুর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বসুর নামে অ্যাকা়ডেমির জমি না পাওয়ার প্রসঙ্গ অশোকবাবু তোলেননি। হয়তো ‘ছোট বোন’কে অস্বস্তিতে ফেলতে চান না বলেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement