কোথাও যাওয়ার নেই, মমতার মঞ্চে গানওলা

এক জন বললেন, ‘সুমনদা তুমি যে পুরস্কার নিতে রাজি হয়েছ, এই যথেষ্ট!’ গানওলা গান ধরলেন, ‘আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই!’ শুক্রবার, নজরুল মঞ্চে সঙ্গীতমেলার উদ্বোধনী আসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবীর সুমনের দেখা হল, বছর চারেকেরও পরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share:

কবীর সুমনকে মহাসঙ্গীত সম্মানে ভূষিত করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ আচার্য।

এক জন বললেন, ‘সুমনদা তুমি যে পুরস্কার নিতে রাজি হয়েছ, এই যথেষ্ট!’

Advertisement

গানওলা গান ধরলেন, ‘আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই!’

শুক্রবার, নজরুল মঞ্চে সঙ্গীতমেলার উদ্বোধনী আসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবীর সুমনের দেখা হল, বছর চারেকেরও পরে।

Advertisement

সুমনের সঙ্গে আরও বেশ কয়েক জনের সঙ্গে মহাসঙ্গীত সম্মানে ভূষিত করা হলেও তিনিই যে এই সন্ধ্যার প্রধান চরিত্র, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা ও অভিব্যক্তিতে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে এই মিলন-পর্ব স্রেফ প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চেই আটকে থাকবে, না গভীরতর রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা পাবে, সে-প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। সুমন নিজে বা তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এমন জল্পনা উড়িয়ে দিচ্ছেন।

ভাষা-দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব সুমন ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে আগেই দাবি করেছিলেন। এ দিন প্রশ্ন ওঠে, এর পরে যদি তৃণমূল তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ হতে প্রস্তাব দেয় তবে কী করবেন? সুমনের জবাব: “আমার মনে হয় না, তৃণমূলের মাথা এতটা খারাপ হয়েছে যে, ওঁরা এমন প্রস্তাব দেবেন।” এমন একটা সম্ভাবনা যে কার্যত অবিশ্বাস্য তা বুঝিয়ে সুমনের মন্তব্য, “তা হলে আমি যেখানে পারব, বালতির পর বালতি জল ঢালতে শুরু করব।” পক্ষান্তরে তৃণমূলের এক শীর্ষনেতাও এ দিন বলেছেন, “এ যাত্রা তৃণমূল ও সুমনের মধ্যে যোগসূত্র মহাসঙ্গীত সম্মান-প্রাপ্তির বেশি দূর গড়াবে না। তাঁকে একবার লোকসভায় সাংসদ করে দলকে যা ভুগতে হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতেও কখনওই তৃণমূল সে ঝুঁকি নেবে না।” ওই নেতার আরও দাবি, ভবিষ্যতে নেত্রী ফের সুমনকে নিয়ে কিছু পরিকল্পনা করলে দলের নেতারাই তার বিরোধিতা করে মমতাকে বোঝাবেন।

অনুষ্ঠান-পর্ব সেরে বেরনোর সময়ে সুমনও অবশ্য এ দিন বলেছেন, “আমি রাজনীতির লোক নই! রাজনীতি আমার লাইন নয়। সংবাদমাধ্যম অহেতুক তিলকে তাল করে থাকে।” তবে তিনি মেনে নিয়েছেন, “আমি রাজনীতির লোক না-হলেও রাজনৈতিক লোক।” নাগরিক আন্দোলনের মানুষ বা প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক চরিত্র হিসেবেই তিনি এখন বিজেপির ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির বিরোধিতায় তৃণমূলের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছেন বলে তাঁর দাবি। ২০১৬-র ভোটে তিনি যে মমতার দলকেই ভোট দেবেন,

তা-ও ফেসবুকে রাখঢাক না-করেই বলেছেন সুমন।

সাম্প্রতিক অতীতে মমতার সরকারের নানা ভূমিকার নিন্দা করলেও এ দিন সুমন বলেন, “কিছু খারাপ ঘটনা ঘটলেও ইতিবাচক ঘটনাই বেশি ঘটছে।” কয়েক মাস আগে খাগড়াগড়-কাণ্ডের সময় থেকেই নানা অপপ্রচারে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে বলে সুমন বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। এবং তখনই ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’-এই নীতিতে তৃণমূলের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বের কথাও প্রকাশ্যে কবুল করেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, সুমন-বিষয়ে মমতার অবস্থান বদলের সঙ্গে সুমনের এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির যোগ রয়েছে। ফলে স্বভাবতই জনমানসে ধারণা হচ্ছে, এত দিন বাদে মমতা যে সুমনকে পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিলেন, তা আদতে রাজনৈতিক। কিন্তু সুমন নিজে যে তা গায়ে মাখতে চান না, তা এ দিন আবারও বুঝিয়ে দেন তিনি। সুমন বলেন, “এই পুরস্কারটি শুধু কবীর সুমনই পাচ্ছে না। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নাকতলা শাখায় আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটিও পুরস্কার পাচ্ছে। টাকাটা আমার দরকার।”

সুমনকে দিয়েই শুরু হয় এ দিনের পুরস্কার-প্রদান। এর পরে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মুম্বইয়ের অভিজিৎ প্রমুখ বেশ কয়েকজন শিল্পীকে মহাসঙ্গীত ও সঙ্গীত সম্মান প্রদানের পরে শেষ পাতে সুমনকে দু’কলি শোনানোর জন্য ফের মঞ্চে ডাকা হয়। প্রথমে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম গিয়ে সুমনকে অনুরোধ করেন। সুমন রাজি হচ্ছেন না দেখে মমতা মঞ্চ থেকে বলেন, ‘এত জনের গান শুনলাম, কবীর সুমনকে কি ছেড়ে দিতে পারি!’

তখন মঞ্চে উঠে মমতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে কতটা গভীর ও পুরনো তা উপস্থিত অতিথি ও শিল্পীদের মনে করিয়ে দেন সুমন। সাংসদ হওয়ার পরে পারস্পরিক তিক্ততার জেরে যদিও তাঁদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শাসক মমতার ঘনিষ্ঠ শিল্পীদের কার্যত খোঁচা দিয়েই সুমন শুনিয়ে দেন, যখন মমতার পাশে সংস্কৃতি-জগতের প্রায় কেউ ছিলেন না, তখন কিন্তু তিনিই ছিলেন। মমতাকে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী না বলে ‘মাননীয় নেত্রী’ সম্বোধন করেছেন সুমন। বলেছেন, “যিনি এ অনুষ্ঠানের প্রাণ, সেই মাননীয় নেত্রীর পাশে বসাটাই এক সময়ে এ দেশে মুশকিল ছিল। এর জন্য মাননীয় প্রগতিশীল বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক গালাগাল শুনতে হয়েছে।” ‘ও গানওলা’ গেয়ে শোনানোর আগে সুমন ধরেন, নন্দীগ্রাম-পর্বে মমতাকে নিয়ে বাঁধা একটি গান। ‘বামের পাশে বসলে সিদ্ধকাম, বামের ঘরে সেঁধিয়ে গেলেই হয় / তোমার পাশে বসলেই বদনাম, সেই কারণেই চাইছি তোমার জয়!’

ফের মূলস্রোতের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা অস্বীকার করেও গানের মধ্যেই সুমন তাঁর রাজনীতির বার্তাটি পৌঁছে দেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement