বেলা ১২টা ১১। কৃষ্ণনগর জেলা প্রশাসনিক ভবন। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
রাজ্যে কর্মসংস্কৃতির নজির রাখতে ধর্মঘটের দিনে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ফরমান জারি করেছিলেন তিনি। সরকারি কর্মীদের ভিড়ে-ঠাসা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে শুক্রবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সগর্ব ঘোষণা, ‘‘রাজ্যে আমরা কর্মসংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছি।’’ কিন্তু তাঁর সেই সমাবেশই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল বঙ্গে কর্মসংস্কৃতির আসল ছবিটা!
একে তো নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনে’র বার্ষিক কনভেনশন সফল করার জন্য এ দিন প্রায় খালি হয়ে গেল রাজ্য জুড়ে তাবৎ সরকারি দফতর! প্রথমত, শাসক দলের সংগঠনের ডাক। এবং দ্বিতীয়ত, বিপুল বকেয়া মহার্ঘ ভাতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী ঘোষণা করেন, তা নিয়ে অপার কৌতূহল। এই দুইয়ের টানে এ দিন জেলা থেকেও দলে দলে সরকারি কর্মচারী ভিড় জমিয়েছিলেন কলকাতার স্টেডিয়ামে। তার জন্য কেউ অর্ধদিবস, কেউ গোটা দিন, কেউ আবার দে়ড় দিন ছুটি নিয়ে ফেলেছিলেন! জেলায় জেলায় প্রশাসনিক ভবনের শূন্য টেবিল-চেয়ার যখন কর্মসংস্কৃতির অব্যর্থ চিহ্ন বহন করছে, তখনই মুখ্যমন্ত্রীর আরও একটি ঘোষণা সেই সংস্কৃতিতেই নতুন মাত্রা যোগ করল!
বিকেল ৩টে। হাওড়ার নিউ কালেক্টরেট ভবন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
বাম-সহ সব ক’টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা গত ২ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের দিন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মচারীদের আগের রাত দফতরে কাটাতে হয়েছিল। ধর্মঘটের সন্ধ্যায় আপ্লুত মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, যাঁরা এ ভাবে কাজ করে পরিষেবা চালু রাখলেন, তাঁদের তিনি পুরস্কৃত করতে চান। নেতাজি ইন্ডোরে এসে কথা রাখলেন মমতা। বললেন, ওই দিন ধর্মঘটে কাজে যোগ দেওয়া সরকারি কর্মচারীরা এক দিন অতিরিক্ত ছুটি (কম্পেনসেটরি ক্যাজুয়াল লিভ বা সিসিএল) পাবেন। কনভেনশনে উপস্থিত সরকারি কর্মীরা হাততালি দিলেন ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন উঠে গেল, যাঁরা ধর্মঘটকে কাজের দিন হিসেবেই ধরতে চান, তাঁরা সে দিন কাজ করবেন— এটাই তো স্বাভাবিক! তা হলে সে দিনের বিনিময়ে ছুটি কেন? রীতি অনুযায়ী, সিসিএল দেওয়া
হয় কোনও ঘোষিত ছুটির দিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য কর্মীরা কাজ করতে বাধ্য হলে। তা হলে কি ধর্মঘটকে ‘ছুটির দিন’ হিসেবেই স্বীকৃতি দিল মমতার সরকার?
বিকেল ৩টে ১০। তমলুকে জেলা প্রশাসনিক ভবন। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
মুখ্যমন্ত্রীর কনভেনশনের ধাক্কায় কোচবিহার থেকে কলকাতা— প্রায় সর্বত্রই সরকারি কাজ লাটে উঠেছিল এ দিন। যাঁরা সমাবেশে যাননি, তাঁদেরও অনেকে ছুটির আবহে দফতরে এসে বারোটা বাজতে না বাজতেই ‘সভায় যোগ দেওয়া’র ছুতো দেখিয়ে ‘কেটে’ পড়েছেন! পরিষেবা নিতে এসে খালি হাতে ফিরেছেন সাধারণ মানুষ। আর শাসক দলের কর্মী সংগঠনের সমাবেশ-মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আপনারা যাঁরা বন্ধের দিনে কাজে এসেছেন, তাঁদের সেলাম জানাই! যারা বন্ধ করে, সরকারকে পিছিয়ে দেয়, রাজ্যকে পিছিয়ে দেয়, তাদের বেতন কেটে নেওয়া হবে। আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। আর যাঁরা কষ্ট করে এসেছেন, তাঁদের ছুটিটাকে আমরা পুষিয়ে দেব। তাঁরা কম্পেনসেটরি ক্যাজুয়াল লিভ হিসেবে এক দিন ছুটি বেশি পাবেন।’’
রাজ্য প্রশাসনের একাংশও মানছে, এ দিনের জোড়া ধাক্কায় কর্মসংস্কৃতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের অবস্থানই অনেক লঘু হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই সরব বিরোধীরাও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘সারা দেশে ধর্মঘটের দিন একমাত্র এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাঁত-নখ বার করলেন। আবার এখন সেই ধর্মঘটের দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করলেন! মেনে নিলেন, সে দিন কাজ হয়নি, ছুটির দিন ছিল!’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার প্রশ্ন, ‘‘তা হলে ১৮ অগস্ট কংগ্রেসের বন্ধ বা ২ সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের দিন কেন সরকার বলেছিল, কাজে না এলে বেতন কাটা হবে? আজ যে সেই কর্মীদের কাজ থেকে সরালেন, এর শাস্তি কে পাবে? মুখ্যসচিব কি কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন?’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, ‘‘বন্ধ হলে কাজে না গেলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এখন সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সভা করেছেন। সমস্ত অফিস ফাঁকা। এটা হবে কেন?’’
মুখ্যমন্ত্রীর সিসিএল-এর ঘোষণায় রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ যেমন চমৎকৃত, হতবাক শাসক দলের কর্মী সংগঠনের কিছু নেতাও! তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘ধর্মঘট যে সফল হয়েছে, সেটাই তো সরকার কার্যত মেনে নিল!’’ যদিও সংগঠনের আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাসের দাবি, ‘‘সরকারি কর্মীরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে ওই দিন কাজে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কর্মীদের প্রতি ভালবাসার খাতিরে পুরস্কার দিয়েছেন। এটা নেতিবাচক ভাবে দেখা উচিত নয়।’’ বিজেপি-প্রভাবিত কর্মী সংগঠনের নেতা সঙ্কেত চক্রবর্তীর আবার কটাক্ষ, ‘‘২ সেপ্টেম্বরকে ছুটির দিনের তকমা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে তিনি বাম ও কংগ্রেসের ডাকা বন্ধকে স্বীকৃতি দিলেন!’’
বিকেল ৩টে ৩০। কলকাতার খাদ্যভবন। ছবি: সুমন বল্লভ।
ধর্মঘটের দিনকে ‘ছুটি’ ঘোষণার আগেই অবশ্য এ দিন অন্য ছুটি পালন করে ফেলেছেন সরকারি কর্মীদের বড় অংশ! ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ফেডারেশনের সমাবেশ হয়েছিল শনিবার। সেই অর্থে এ বারই ব্যতিক্রম। সংগঠনের নেতৃত্বের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর সময় পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই কাজের দিনে সভা করতে হয়েছে। কিন্তু তার মাসুল গুনেছে জেলায় জেলায় অজস্র দফতর। সমাবেশ ছিল বেলা তিনটে থেকে। কিন্তু সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য কাছের জেলার কর্মীরা এ দিন ভোরে এবং কোচবিহার, জলপাইগুড়ির মতো দূরের জেলার কর্মীরা রওনা দিয়েছেন বৃহস্পতিবার বিকেলেই, হাফ ছুটি নিয়ে! কোচবিহারের মাথাভাঙার আইসিডিএস প্রকল্পের এক কর্মীর কথায়, ‘‘জেলা থেকে ৭০-৮০ জন সভায় এসেছি কাল বিকেলে রওনা দিয়ে। তার জন্য কালও হাফ ছুটি নিতে হয়েছে। আজ তো পুরোই ছুটি! ভাগ্যিস শনিবার অফিস নেই! নইলে ওই দিনও ছুটি নিতে হতো!’’ দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলাতেও এ দিন ফাঁকা
পড়েছিল সরকারি দফতর। কলকাতায় নবান্নে কিছুটা হাজিরা থাকলেও মহাকরণ, নব মহাকরণ-সহ সল্টলেকের সরকারি সব দফতরে হাজিরা ছিল ৪০%-এরও কম! সল্টলেকের জলসম্পদ ভবনে কর্মরত এক
জনের কথায়, ‘‘আমরা তো একটায় বেরিয়ে এসেছি। হাফ সিএল-ও নিতে হয়নি। দলের সভা, কে কী বলবে!’’