পড়লেন লিখিত বক্তৃতা, রইলেন খানিক অন্তরালে

তাঁকে ঘিরেই সব আয়োজন। তবুও সিঙ্গাপুরের মাটিতে শিল্পপতিদের সামনে নিজেকে যেন কিছুটা অন্তরালেই রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার শিল্প সম্মেলনে সিঙ্গাপুরের ৮৯টি শিল্প সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে এলেন মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। ওই সময়টুকুতে অবশ্য নিজেকে সিঙ্গাপুরের ‘ছোট বোন’ দাবি করে রাজ্যের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

সিঙ্গাপুর শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৯
Share:

সিঙ্গাপুরের শিল্প সম্মেলনে মমতা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

তাঁকে ঘিরেই সব আয়োজন। তবুও সিঙ্গাপুরের মাটিতে শিল্পপতিদের সামনে নিজেকে যেন কিছুটা অন্তরালেই রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার শিল্প সম্মেলনে সিঙ্গাপুরের ৮৯টি শিল্প সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে এলেন মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। ওই সময়টুকুতে অবশ্য নিজেকে সিঙ্গাপুরের ‘ছোট বোন’ দাবি করে রাজ্যের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘোষণা করলেন এক গুচ্ছ বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের কার্যক্রম। সেই সঙ্গে জানুয়ারি মাসে কলকাতায় বেঙ্গল লিডসের মঞ্চে ডাক দিলেন সিঙ্গাপুরের শিল্প সংস্থাগুলিকে। সই হল ১৩টি নানা ধরনের চুক্তিও। সময় বলবে তার ক’টি বাস্তবায়িত হল।

এ দিনের সম্মেলনে সিঙ্গাপুরের শিল্প সংস্থাগুলিকে নিয়ে আসার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়েছে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। স্থানীয় সংবাদপত্রে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে প্রতিনিধিদের জন্য ‘বিশ্ববাংলা’ ব্রা্যন্ডের নামে নানবিধ উপহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিগমের কর্তারা আগেভাগে সিঙ্গাপুরে এসে ‘নেটওয়ার্কিং’ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে ৮৯টি শিল্প সংস্থার যে সব প্রতিনিধি এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই মাঝারি মাপের কর্তা। কোনও বড় সংস্থার কোনও চেয়ারম্যান বা সিইও হাজির ছিলেন না। এমনকী, চাঙ্গি এয়ারপোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যানকেও দেখা যায়নি। যদিও তাদের সঙ্গে রাজ্যের তিনটি চুক্তি সই হল এ দিন। ব্যতিক্রম বলতে ব্ল্যাকস্টোনের চেয়ারম্যান গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

অধিকাংশ মাঝারি মাপের শিল্পকর্তাদের যখন রাজ্যে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, আশ্বাস দিচ্ছেন সাহায্যের, তখন বোঝা যাচ্ছিল না তিনি সিঙ্গাপুরের মাটিতে রয়েছেন, নাকি কলকাতার কোনও বণিকসভায়। কলকাতার আর পাঁচটা অনুষ্ঠানের মতোই সিঙ্গাপুরের সাঙ্গরি লা হোটেলে বিদেশি সংস্থার কর্তাদের সামনে তিনি বললেন, “জানেন কী অবস্থায় রাজ্যটা হাতে পেয়েছি? ৩৪ বছরের বাম শাসনে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। রোজগারের বেশির ভাগ টাকাই ধার আর সুদ মেটাতে চলে যাচ্ছে।” তবে তাতে যে তিনি দমছেন না, তা জানিয়ে মমতা বলেন, “তিন বছর ঘর সামলাতে গেল। ১৫ বছর পর বিদেশে এলাম। রাজ্যের জন্য বিনিয়োগ পেতেই এখানে আসা। কারণ, সিঙ্গাপুর থেকে মাত্র ৪ ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছনো যায়।” একই ভাবে ক্ষুদ্র শিল্প, শ্রমদিবস নষ্ট না হওয়া, কন্যা ভ্রূণ হত্যার সংখ্যা কমা, একশো দিনের কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও যে রাজ্য এক নম্বরে রয়েছে, তা সিঙ্গাপুরের শিল্পপতিদের বিশদে জানান মমতা।

তবে দেশে শিল্প সম্মেলন হোক বা কন্যাশ্রী প্রকল্পের অনুষ্ঠান, মুখ্যমন্ত্রীই সর্বেসর্বা থাকেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরে মমতা এগিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের শিল্পপতিদেরই। বাংলায় বিনিয়োগ করেছেন এমন ১৩ জন লগ্নিকারী সিঙ্গাপুরের শিল্পকর্তাদের সামনেরাজ্যের শিল্পবান্ধব পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সঞ্জীব গোয়েন্কা থেকে হর্ষ নেওটিয়া, কর্ণ পল থেকে ওয়াই কে মোদী, কুরুশ গ্রান্ট থেকে সুমিত মজুমদার সকলেই রাজ্যকে বিনিয়োগের আদর্শ গন্তব্য হিসাবে তুলে ধরেন। উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠীর কর্ণধার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ও। মমতা তখন সম্মেলনে ছিলেন না। শিল্পপতিদের বক্তব্য শেষের পরই তিনি মঞ্চে ওঠেন। তাঁর কথায়, “আমি কোনও প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি না। এখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পের অধিনায়করা এসেছেন। তাঁদের নেতৃত্বেই আমি এসেছি। তাঁরাই আপনাদের যা বলার বলেছেন।”

অবিশ্বাস্য হলেও এ দিন প্রায় ৪০ মিনিট নিজেকে লিখিত ভাষণেরই বন্দি রেখেছিলেন মমতা। মাঝে-মধ্যে দু’এক বার নিজের কথা বলা ছাড়া সরকারি অফিসারদের তৈরি করে দেওয়া বক্তৃতার বাইরে বেরোতে দেখা যায়নি তাঁকে। কোনও প্রশ্নোত্তর পর্বেও অংশ নেননি। সাধারণত কোনও শিল্প সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পকর্তাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব রাখা হয়। এখানেও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতার বক্তৃতা শেষ হতেই মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র ধন্যবাদ জানিয়ে সম্মেলন শেষ করে দেন। তাতে হতাশ হন সিঙ্গাপুরের শিল্প কর্তাদের অনেকেই। যদিও শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্তারা জানাচ্ছেন, প্রশ্নোত্তর পর্ব না থাকলেও অনুষ্ঠান শেষে সিঙ্গাপুরের শিল্পকর্তাদের সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন।

তবে অনেকেরই মতে, প্রশ্নোত্তর পর্বে জমি অধিগ্রহণ বা এফডিআইয়ে আপত্তির প্রসঙ্গ উঠে অস্বস্তি বাড়াতে পারে আন্দাজ করেই বিদেশের মাটিতে ঝুঁকি নিতে চাননি মমতা। অনুষ্ঠানের একটা নির্দিষ্ট অংশে যোগ দিয়ে এবং লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে কিঞ্চিৎ সাবধানী আড়ালই বজায় রেখেছেন।

এ দিন কেভেন্টার্স গোষ্ঠীর সঙ্গে ডানকুনি ফুড পার্কে ১০০০ কোটি টাকা লগ্নির চুক্তি হয়েছে ইনফ্রাকো এশিয়ার। বাটানগর উপনগরীতে ২০০ কোটি টাকা লগ্নি সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে জিআইসি-সিঙ্গাপুরের সঙ্গে হাইল্যান্ড গোষ্ঠীর। সিঙ্গাপুরের সরকারি নগরোন্নয়ন সংস্থা সারবানা-র সঙ্গে ক্রেডাই, বিএপিএল এবং কেভেন্টার্স-এরও একাধিক চুক্তি হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ভবিষ্যতে আরও লগ্নির দরজা কি খুলে দিতে পারবে এই শিল্প সম্মেলন? যে মাঝারি মাপের শিল্পকর্তারা এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনলেন, তাঁদের লগ্নির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, সেটাও প্রশ্ন। যদিও সরকারি কর্তারা এখনই হাল ছাড়তে নারাজ। এক কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা যাঁরা শুনলেন তাঁদের লগ্নি করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কতটা, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে শুরুর জন্য এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম।” রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “সিঙ্গাপুরের মাটিতে ৪০ জন লোক জোগাড় করা বেশ কঠিন। সে ক্ষেত্রে ৮৯টি শিল্প সংস্থার নাম তো তালিকাতেই দেখলাম। এর বাইরেও অনেকে ছিলেন।”

যাঁর ছিলেন রাজ্যের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা কী? তহবিল ব্যবস্থাপনা সংস্থা জিআইসি এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের অন্যতম ডিরেক্টর গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মেলনে বলেন, “কথা তো অনেক হয়, কিন্তু কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। আশা করব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে প্রয়াস নিয়েছে, লেগে থেকে তা বাস্তবায়িত করবে।”

সময় মেনে প্রকল্প রূপায়ণের কিছু ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী এ দিনই করেছেন। যেমন, কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে ১৮ মাসের মধ্যে সিঙ্গাপুর-কলকাতা বাণিজ্যকেন্দ্র তৈরি করা। সিঙ্গাপুরে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের অফিস তৈরি করার কথাও জানান তিনি। সিঙ্গাপুরের একটি বণিকসভা যে তাদের অফিসেই শিল্পোন্নয়ন নিগমকে জায়গা দেবে সে কথাও জানান মমতা। এ ছাড়া, আগামী ৭-৮ জানুয়ারি কলকাতায় বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। ওই সময়েই বসবে বার্ষিক ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আসর। এ দিন শিল্প সম্মেলনে সে কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কলকাতার শিল্প সম্মেলনে সবাইকে যেতে হবে। যাবেন তো?” সভা জুড়ে তখন হাততালি।

তার পরেই মান্দারিন, তামিল এবং মালয় ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কুইং জাই ওয়েস্ট বেঙ্গল তওজি। মুতালিতু ওয়েস্ট বেঙ্গল। মারি মে লেবুর দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল।”

যার অর্থ, আসুন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement