উভয় সঙ্কট আর কাকে বলে!
বছরের পর বছর বামকে গাল না পেড়ে ঘুম হতো না তাঁর। মাঝে এমন কথাও বলতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে যে, এক কালে কংগ্রেস করেছেন ভাবতে লজ্জা হয়! এখন রাম নামের শোরগোল যত তীব্র হচ্ছে, পুরনো সেই জাতশত্রুদের কথাই মনে পড়ছে তাঁর! রাজনীতির পরিহাস এমনই!
পুরভোটের প্রস্তুতির ছক কষতে বসে কালীঘাটে দলীয় সতীর্থদের এক প্রস্ত তিরস্কার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির বিপদ বাড়ছে, শহরে তাদের ভোট বেড়েছে অথচ পুরসভার বরো চেয়ারম্যান এবং অন্য নেতারা কি ঘুমোচ্ছিলেন? ভর্ৎসনার সুরে জানতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সেই সঙ্গেই তাঁর উপলব্ধি, সিপিএম নাকি সব বিজেপি হয়ে গিয়েছে! আর কংগ্রেস একেবারে শুয়ে পড়েছে! তাই বিজেপির সঙ্গে লড়াইটা তাঁদের করতে হবে, দলের নেতাদের নির্দেশ মমতার।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাম এবং কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা ক্ষয়ে গেলে শাসক মমতার চিন্তা কেন? উত্তরটা লুকিয়ে ভোটের পরিসংখ্যানে। যত দিন যাচ্ছে, রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ জমে উঠছে। একের পর এক ঘটনায় শাসক দলের বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভ বাড়ছে আর প্রচারের ঝড়ে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি! সুব্রত বক্সী থেকে স্বয়ং মমতা, সকলেরই কথায় এই একই উপলব্ধি। এবং এখানেই শেষ নয়। উপলব্ধির ঠেলায় তৃণমূলের শুদ্ধকরণও নাকি আটকে যাওয়ার উপক্রম! কারণ, কালীঘাটে সোমবারের বৈঠকেই মমতা বলেছেন, দলে অনেকের কাজকর্মের খবর তিনি রাখেন। এঁদের বহিষ্কার করে দেওয়া উচিত। কিন্তু দলীয় নেতাদের প্রতি তাঁরই উপদেশ, এখন তাড়াহুড়ো করে বহিষ্কার করতে যাবেন না! তা হলে এঁরা আবার অন্য দলে গিয়ে ভিড়বেন! নাম করেননি। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপির আতঙ্কেই তিনি দুষ্ট গরু গোয়ালে রাখতে রাজি!
তৃণমূল শিবির থেকেই হিসেব মিলছে, মমতার বিজেপি-আতঙ্কের শিকড় ঢুকে ভোটের ভাগাভাগিতে। কয়েক মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল রাজ্যে পেয়েছিল প্রায় ৩৮% ভোট। মানে প্রায় ৬২% ভোটই সরকার-বিরোধী! কিন্তু বিরোধী ভোট যে হেতু বাম, বিজেপি এবং কংগ্রেসে ভাগ হয়েছে, তাই ৩৮% ভোট পেয়েও গোটা রাজ্যে ৩৪টি লোকসভা আসন ঘরে তুলে আপাতদৃষ্টিতে বিপুল সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। লোকসভায় বামেরা পেয়েছিল ২৯% ভোট, কংগ্রেস ৯.৬%। আর বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ১৭%। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের বাকি বছরদেড়েক। অলৌকিক কিছু না ঘটলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট সেই সময় বেড়ে যাওয়ার কথা। এ বার সাম্প্রতিক প্রবণতা বজায় রেখে বাম ও কংগ্রেসের ভোট ভেঙে যদি বিজেপির ঘরেই ঢোকে, তা হলে অল্প ভোট পেয়েও ভাগাভাগির খেলায় আসন জিতে নেওয়ার অঙ্কে ছাই পড়বে তৃণমূলের! তখন বাড়তি ভোট পেয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দেওয়ার জায়গায় উঠে আসতে পারে বিজেপি-ই। তাই বাম-কংগ্রেস নিয়ে বিলাপ শোনা যাচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর কণ্ঠে!
তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “প্রথমে বিজেপি-কে ধর্তব্যের মধ্যে না আনার কৌশল ছিল। তাতে আত্মসন্তুষ্টি আসছিল দলের মধ্যে। বিপদ বুঝে দলনেত্রী সেই আত্মসন্তুষ্টি থেকে বার করে এনে সকলকে ময়দানে নামতে বলছেন।” কেন এমন সতর্ক-বাণী? ওই নেতার ব্যাখ্যা, “বিরোধী ভোট ভাগ হলে সরকারি দলের সুবিধা হয়, এ তো জানা কথা। বাম আর কংগ্রেস নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারলে আমাদের সুবিধা। কিন্তু বসিরহাট এবং চৌরঙ্গি বিধানসভার উপনির্বাচনের পর থেকে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সে জায়গায় নেই!”
নিশ্চিন্ত তাই থাকতে পারছেন না তৃণমূল নেত্রী। এবং রাজ্য রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বলছে, এর জন্য দায়ী তিনিই! ক্ষমতায় আসার পরে বিরোধী-সাফাই অভিযানে নেমেছিল তৃণমূল। অভিযোগ, সন্ত্রাসের পথে, জবরদস্তি করে ভয় দেখিয়ে বা আর্থিক প্রলোভন দিয়ে পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত হয়ে জেলা পরিষদ বাম এবং কংগ্রেসকে নিরন্তর ভেঙে চলেছে তৃণমূল। কেন্দ্রে বিজেপি আসার পরে নিরাপত্তার আশায় গেরুয়া শিবিরে এখন নাম লেখাচ্ছেন নিচু তলার বাম ও কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা। আর প্রমাদ গুনছেন সেই মমতা। যিনি তাঁদের বিজেপি শিবিরে যেতে কার্যত বাধ্য করেছেন!
রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, “তৃণমূল আসলে আমাদের জন্য লক্ষ্মী! সিপিএম জমানায় রাজ্যে আরএসএস-সহ সঙ্ঘ পরিবারের কাজ গুটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শগত লড়াইয়ের ব্যাপার নেই। তাদের কাজকর্মই আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে।” বিজেপির ওই নেতা মানছেন, “ভালবেসে সবাই আমাদের দিকে আসছেন, এটা নয় ঠিক। কিন্তু রাজনীতি এ ভাবেই চলে। তৃণমূলও এ ভাবেই বেড়ে উঠেছিল।”
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, “বিজেপির সঙ্গে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক লড়াই করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। কিন্তু উনি (মমতা) ক্ষমতায় এসেই বামপন্থীদের আক্রমণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, এই ধরনের আক্রমণ শুরু হয় বামপন্থীদের দিয়েই। পরে আক্রমণকারী বুঝতে পারে, তার পাশে দাঁড়ানোর আর কেউ নেই!” বিজেপি নামক বিপদ যে তৃণমূলের স্বখাতসলিল, অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন সূর্যবাবুরা। তারই স্বীকারোক্তি ঘুরপথে আসছে মমতার গলাতেও!
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও বলছেন, “কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া উনি পরিবর্তন আনতে পারতেন না। কিন্তু ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে ওঁরা কোথাও টাকা-পয়সা দিয়ে, কোথাও মেরেধরে কংগ্রেসকে ভাঙার চেষ্টা করলেন। এখন বুঝতে পারছেন কংগ্রেস দুর্বল হওয়ার বিপদটা কোথায়!”
বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে তৃণমূল ভাবত সংখ্যালঘু ভোটই সহায়। বীরভূমের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সে আশাতেও জল ঢালছে! নিরাপত্তার স্বার্থে, একটু ভাল থাকার আশায় সংখ্যালঘুরাও নাম লেখাচ্ছেন বিজেপি-তে। কেউ ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু, তাই তিনি বিজেপি-তে যেতে পারবেন না এই ভাবনায় ইতি পড়ার ইঙ্গিত মিলছে কেষ্ট-ভূমেই। যে তত্ত্বের কথা আগেই নিজের বইয়ে সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
তৃণমূল নেত্রীর কাছে উপায় তা হলে কী? বিলাপ আর হুঁশিয়ারি? উত্তর সময়ের গর্ভে!