কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওয়ার্মারে পুড়ে দু’টি নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি নিয়ে যে-বিতর্ক ও বিক্ষোভ চলছে, তাকে কার্যত নস্যাৎ করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার তিন বলেন, ‘‘যা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। ওদের
ভাগ্য ভাল যে, বরখাস্ত না-করে সাসপেন্ড করা হয়েছে!’’ মমতার এই গর্জনের দিনেই পাল্টা মুখর হয়েছে নার্সদের একটি সংগঠন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতার পদত্যাগের দাবিও তুলেছে তারা।
এ দিন আমতা স্পোর্টিং মাঠের প্রশাসনিক সভায় জোড়া শিশু-মৃত্যুর ঘটনায় শাস্তির সমালোচনা নিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। ডাক্তার-নার্সদের একাংশের অভিযোগ, তুলনায় নিচু তলার কর্মী-ডাক্তারদের বেশি শাস্তি দিয়ে উঁচু পদের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শাস্তির মাত্রা নিয়ে এই তুলনামূলক সমালোচনাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘বাচ্চা মেরে ফেলবে আর সাসপেন্ড করব না! দু’টো বাচ্চা মারা গেল। আর বলছে কিনা, কেন সাসপেন্ড করা হল! আন্দোলন! বাচ্চা খুন করবে, বাচ্চার আঙুল কেটে দেবে। আবার বলছে, কেন সাসপেন্ড করবে? আমার-আপনার ঘরের বাচ্চা হলে কেমন লাগত? ব্যবস্থা নেবো, নেবো, নেবো।’’
বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতি জড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতি করা ভাল। আমিও রাজনীতি করি। কিন্তু আমি সেই সঙ্গে তো প্রশাসকও। আমরা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। তদন্ত কমিটিই বলেছে।’’
মেডিক্যালের ঘটনায় তিন জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি বা পিজিটি-কে এক মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড হয়েছেন এক নার্স। তা ছাড়া শাস্তি হিসেবে সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট বা এসএনসিইউয়ের প্রধান, আরএমও, সিস্টার ইনচার্জ, নার্সিং সুপার, ডেপুটি নার্সিং সুপারকে বদলি করা হয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। সিনিয়রদের বাঁচিয়ে ওই ঘটনায় জুনিয়রদের বলির পাঁঠা করে সরকার মুখরক্ষা করতে চাইছে বলে কথা ওঠে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই।
তৃণমূল সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী আরও শাস্তির ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। জানিয়েছেন, কেউ ছাড় পাবে না। শিশু-মৃত্যু নিয়ে আরও তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, মেডিক্যালের ঘটনার মাস আড়াই আগে বালুরঘাট হাসপাতালে এক নার্স প্লাস্টার কাটতে গিয়ে এক নবজাতকের আঙুল কেটে ফেলেছিলেন। তিনি এখনও সাসপেন্ড হয়ে আছেন। এ দিন ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে সেই ঘটনাটিকেও টেনে আনেন মুখ্যমন্ত্রী।
মেডিক্যালের ঘটনা নিয়ে আন্দোলনকারীরা অবশ্য শাস্তির সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নন। বিভিন্ন হাসপাতালে লোকাভাবের কথা তুলছেন তাঁরা। মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের যুক্তি, যেখানে দু’টি নবজাতক-প্রতি এক জন নার্স থাকার কথা, সেখানে মেডিক্যালে ঘটনার দিন ১২৮ জন শিশুর জন্য ছিলেন মাত্র ছ’জন নার্স! এ ভাবে কখনও যথাযথ পরিষেবা দেওয়া যায়, প্রশ্ন তুলেছে ওই সংগঠন। সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক অংশুমান মিত্র এই ঘটনায় স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদেরও টানছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘পরিকাঠামোয় নজরদারির দায়িত্ব স্বাস্থ্যকর্তাদেরই। তাঁরা যদি সেই দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত গাফিলতি দেখান, তা হলে তাঁদের গুরুদণ্ড হবে না কেন?’’
খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতার পদত্যাগের দাবি উঠছে এই প্রসঙ্গেই। এই বিষয়ে সরব হয়েছে নার্সদের সংগঠন ‘নার্সেস ইউনিটি’। তাদের তরফে জেলা সচিব পার্বতী পালের প্রশ্ন, এসএনসিইউয়ে এক জন নার্সকে যখন গুরুতর অসুস্থ ২৮টা বাচ্চা সামলাতে হয়, তখন তাঁর কী অবস্থা হয়, মুখ্যমন্ত্রী কি সেটা জানেন? পরিকাঠামো তৈরি না-করে এসএনসিইউ খোলা হয়েছে কেন? ‘‘যদি কর্তব্যে গাফিলতির শাস্তি হিসেবে নার্স-পিজিটিরা সাসপেন্ড হন, তা হলে পরিকাঠামো তৈরির ব্যর্থতার দায় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য স্বাস্থ্যকর্তাদের পদত্যাগ করা উচিত,’’ বলেছেন পার্বতীদেবী।