বাণিজ্য সম্মেলনে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
মাদ্রিদের পর বার্সেলোনা— স্পেনের বণিকমহলের সামনে শিল্পস্থাপন এবং লগ্নির জন্য বাংলার উর্বর মাটির কথা আবার তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রত্যয়ের সঙ্গেই জানালেন, ভারতকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলা। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নতিশীল রাজ্য। আমরাই দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমরাই গেম চেঞ্জার। তাই আমাদের রাজ্যে বিনিয়োগ করুন। কোনও সমস্যা হবে না। জমি থেকে যোগাযোগ, প্রশিক্ষিত শ্রমিক থেকে সরকারি সুবিধা— সবটা পাবেন।’’
মঙ্গলবার মমতার স্পেন সফরের সপ্তম দিন। মাদ্রিদে চার দিন ছিলেন। গত রবিবার বার্সেলোনা পৌঁছন। এল প্যালেস হোটেলের গ্র্যান্ড ভিয়া হলে বসেছিল মঙ্গলবারের শিল্প সম্মেলন। মাদ্রিদের মতো এখানেও কর্মসূচি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বক্তাদের তালিকায় ছিলেন স্পেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েক। তিনিও তাঁর বক্তৃতায় বাংলায় বিনিয়োগের সুবিধার দিক তুলে ধরেন। ভারতীয় শিল্পমহলের তরফে অম্বুজা রিয়্যালটির চেয়ারম্যান হর্ষ নেওটিয়া, টিটাগড় ওয়াগন লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান উমেশ চৌধুরী, প্রবাসী শিল্পপতি কমল মিত্তল, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়ের প্রেসিডেন্ট তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা এবং ফেনেসিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজা বাংলায় বিনিয়োগের সুপরিবেশের কথা তুলে ধরেন।
একটা সময়ে বাংলায় বন্ধ আর ধর্মঘট শিল্পমহলের কাছে বিরক্তির বিষয় ছিল। বার্সেলোনার বণিকমহলের সামনে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আগে বাংলায় ধর্মঘটের সমস্যা ছিল। অনেক কর্মদিবস নষ্ট হত। কিন্তু এখন আমরা সে সব বন্ধ করে দিয়েছি। একটাও কর্মদিবস নষ্ট হয় না।’’ একই কথা উঠে আসে শিল্পপতি হর্ষের বক্তৃতাতেও। অম্বুজা গোষ্ঠীর কর্ণধার বলেন, ‘‘গত ১০ বছরে বাংলায় অভূতপূর্ব পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। শ্রমিক সমস্যা শূন্য, কোনও ধর্মঘট নেই।’’ নেওটিয়া পরিবার ১০০ বছরের বেশি বাংলায় রয়েছে। সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে হর্ষ বলেন, ‘‘বাংলায় কখনও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কখনও তা স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে বাংলা ধারাবাহিক অগ্রগতির পথে এগিয়েছে।’’ স্পেনীয় শিল্পপতিদের সামনে ‘দিদি’ শব্দের ইংরেজি তর্জমা শুনিয়ে হর্ষ বলেন, ‘‘এক জন দিদি যেমন পরিবারকে আগলে রাখেন, তেমনই এই দিদিও রাজ্যকে আগলে রেখেছেন।’’
বাণিজ্য সম্মেলনের অবসরে প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা। —নিজস্ব চিত্র।
শিল্পপতি উমেশে চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমাদের সংস্থা ইউরোপের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করছে। কিন্তু আমাদের শুরু থেকে বড় হওয়া— সবটাই বাংলায়। বিনিয়োগের যথার্থ পরিবেশ রয়েছে বলেই অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে রাজ্য।’’ সোমবার মিত্তল গ্রুপ রাজ্যে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছিল। তাদের কর্তা কমল সোমবার হাজির ছিলেন এল প্যালেস হোটেলের বাণিজ্য সম্মেলনে। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে মমতার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।’’
মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স গ্রুপের তরফে তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা বলেন, ‘‘বাংলায় বিনিয়োগের আদর্শ পরিবেশ রয়েছে বলেই গত ১০ বছরে সেই রাজ্যে রিলায়্যান্সের মতো সংস্থা পাঁচ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তার বেশির ভাগটাই টেলি যোগাযোগ ক্ষেত্রে।’’ তিনিও মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মমতাদি’ বলে সম্বোধন করেন। এবং বলেন, ‘‘মুকেশ অম্বানী চান বাংলার সঙ্গে আমাদের মজবুত সম্পর্কটা যেন টিকে থাকে।’’ শিল্পপতি রমেশ জুনেজা বলেন, ‘‘চর্ম শিল্পে বিনিয়োগের জন্য বাংলা এখন পৃথিবার অন্যতম সেরা গন্তব্য।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি বানতলা লেদার কমপ্লেক্সের কথা তুলে ধরেন।
বাংলা যে গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক বদলের পথে এগিয়েছে সে কথা উল্লেখ করেন স্পেনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েকও। তাঁর কথায়, ‘‘মমতার নেতৃত্বে বাংলায় বহুমুখী পরিবর্তন হয়েছে। ১০ বছরে বদলে গিয়েছে বাংলা।’’ একই সঙ্গে তিনি বাংলার ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধার কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, ‘‘বাংলা ১১ কোটি মানুষের রাজ্য। আর বাংলা হল আরও কয়েক কোটি মানুষের বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রবেশপথ।’’
সম্মেলনের মঞ্চ এবং অভ্যাগতদের একাংশ। —নিজস্ব চিত্র।
বার্সেলোনার বাণিজ্য সম্মেলনে শুধু বিনিযোগের আবেদনই জানাননি মমতা, তাঁর সরকারের সামাজিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন। সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ের কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘সমাজের দরিদ্রতম অংশের জীবনে আলো জ্বালাই আমাদের লক্ষ্য। সেই কাজই আমরা করে চলেছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্পেন যেমন ইউরোপে নবজাগরণ শুরু করেছিল, বাংলা তেমন ভারতে নবজাগরণ শুরু করেছে।’’ স্পেনের সঙ্গে বাংলার যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে, তা-ও মঙ্গলবার উল্লেখ করেন মমতা। দিদি বলেন, ‘‘আপনারা আঁকা পছন্দ করেন, আমরাও তাই। আপনারা সঙ্গীতভক্ত, আমরাও তেমন। আপনারা যেমন ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা রয়েছে, বাংলাও তেমন ফুটবল পাগল।’’ লা লিগার সঙ্গে রাজ্য সরকারের ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা বলে মমতা বলেন, ‘‘আমরা একটা গোটা স্টেডিয়াম ওদের দিয়ে দিচ্ছি।’’
স্পেনের বণিকমহলের প্রতিনিধি হিসাবে বাণিজ্য সম্মেলনে ছিলেন ‘পিমেক’-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধিকর্তা হাসিন্তো সোলের মাতুতেস। পিমেক হল কাতালোনিয়ার ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পমালিকদের প্রায় ৫০ বছরের পুরনো সংগঠন। হাসিন্তো মমতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন বিনিয়োগের ডাক নিয়ে।’’ মাতুতোস ইঙ্গিত দিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোট হয়ে গেলেই তাঁরা ভারতে বিনিয়োগের ব্যাপারে অগ্রসর হবেন। এশিয়ার আরও দুই দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও যে তাঁদের নজরে রয়েছে তা-ও উল্লেখ করেন তিনি।
কাতালোনিয়ার শিল্পপতিদের ১৯৭১ সালে তৈরি বণিকসভা ‘ফোমেন্ট’-এর তরফ থেকে ছিলেন তাদের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধিকর্তা কিলিয়ান গার্সিয়া। গার্সিয়া বলেন, ‘‘আশা করি ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব।’’ বণিক সংগঠন কাসা এশিয়ার বাণিজ্য অধিকর্তা আমাদেও হেনসানা বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বদলাচ্ছে। নতুন নতুন জায়গাও উঠে আসছে। আমরা সেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই পশ্চিমবঙ্গকে দেখছি।’’
মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে ছিলের রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী, শিল্পসচিব বন্দনা যাদব। গোটা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তৃতা দেন শিল্পপতি মেহুল মোহানকা।
বার্সেলোনার এই বাণিজ্য সম্মেলনের আগেই অবশ্য স্প্যানিশ মুলুক থেকে বাংলায় বিনিয়োগের রাস্তা খুলতে শুরু করে দিয়েছে। শিলিগুড়ি এবং নিউ জলপাইগুড়িতে মোট ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছে পিসি মিত্তল গ্রুপ। সোমবার রাজ্যের মুখ্যসচিব, শিল্পসচিব এবং অন্য শিল্পপতিদের একটি প্রতিনিধি দল স্পেনের শহর কনস্ট্যান্টির ট্র্যাভিপোসে সে দেশের অন্যতম রেল কোচ তৈরির সংস্থা পিসি গ্রুপের মালিকানাধীন ‘রেলওয়ান’-এর কারখানা পরিদর্শন করেন। কারখানা পরিদর্শনের পরেই কমল ঘোষণা করেছিলেন, শিলিগুড়িতে ইথানল তৈরির কারখানা তৈরি করা হবে। সে জন্য বিনিয়োগ করা হবে ১৫০ কোটি টাকা। কারখানাটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে দৈনিক দু’লক্ষ লিটার। এ ছাড়াও নিউ জলপাইগুড়িতে একটি নতুন আধুনিক কংক্রিট স্লিপ (যে কংক্রিটের ব্লকের উপর রেললাইন পাতা থাকে) তৈরির কারখানার জন্য ১০০ কোটি বিনিয়োগ করা হবে।
রবিবার বার্সেলোনায় প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলাপচারিতার অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় শহরের এল প্যালেস হোটেলে। মমতা সেখানে বক্তৃতাও করেন। তার পরে প্রবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তায় অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে অনেক বাঙালি ছিলেন। অনেক অবাঙালিও। সেই আলাপচারিতায় সতীশ রাই সিঙ্ঘানি নামে এক প্রবাসী ভারতীয় মমতার কাছে কলকাতায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারখানা গড়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। সতীশ জানান, তিনি বার্সেলোনায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সোগো গ্রুপের চেয়ারম্যান। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘চিন, তাইওয়ানের মতো জায়গায় আমাদের জিনিস তৈরি হয়। রফতানিও হয়। আমরা চাই, আমাদের জিনিস আমাদের দেশেও তৈরি হোক। কলকাতা কিংবা তার আশপাশে কোথাও আমরা কারখানা তৈরি করতে চাই। আমাদের কাছে ভাল শ্রমিক রয়েছে। রয়েছে উন্নত প্রযুক্তিও। আপনি যদি বিষয়টি একটু দেখেন।’’ এ কথা শুনে মুখ্যমন্ত্রীও উজ্জ্বল মুখে বলেন, ‘‘আপনাকে আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার যা কিছু জানবার আছে, তা আমাদের শিল্পসচিব বন্দনা যাদব এবং মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর থেকে জেনে নিন।’’
মমতার এই স্পেন সফরের মূল উদ্দেশ্য দু’টি। বাংলার ফুটবলের উন্নতি এবং রাজ্যে লগ্নি আনা। এর আগে মাদ্রিদেও বাণিজ্য সম্মেলন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। স্পেনের বণিকমহলকে মমতার বার্তা ছিল, ‘‘বাংলায় সব আছে। আপনারা এসে দেখে যান।’’ চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে স্পেনীয় শিল্পপতিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। মাদ্রিদের মঞ্চে হাজির ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তথা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন প্রধান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। সৌরভ ওই মঞ্চে ঘোষণা করেছিলেন, বাংলায় তাঁর দ্বিতীয় ইস্পাত কারখানাটি গড়ে উঠতে চলেছে। পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যেই সেই কাজ শুরু হবে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনীতে।