নবান্নে সর্বদল বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিটিআই
রাজ্যে ‘আমপান’-পরবর্তী সময়ে ত্রাণ ঘিরে বিস্তর অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির জন্য মুখ্যসচিব, জেলাশাসক ও বিডিও-দের দায়িত্ব দিল রাজ্য সরকার। নবান্নে বুধবার সর্বদল বৈঠকে বিরোধীদের বক্তব্য শোনার পরে প্রথম পর্যায়ে ওই তালিকা তৈরির জন্য ৭ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা টাঙিয়ে দিতে বলা হয়েছে বিডিও দফতরে। পাশাপাশিই আম জনতার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন, কেউ যেন বিডিও দফতর বা অন্যত্র ভাঙচুর না করেন। তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদল কমিটিও গড়া হয়েছে। সেই কমিটি ক্ষতিপূরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করার পরে রাজ্য তা পাঠাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।
নবান্নের সর্বদল বৈঠকে এ দিন প্রত্যাশিত ভাবেই বাম, বিজেপি ও কংগ্রেসের নেতারা ঘূর্ণিঝড়ের পরে ত্রাণ বিলি ঘিরে দলবাজি ও দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছিলেন। যার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিপন্ন মানুষের বঞ্চনা বা ত্রাণে দলবাজি সহ্য করা হবে না। সরকারি ক্ষতিপূরণ থেকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের যাঁরা বাদ গিয়েছেন, নতুন করে তাঁদের তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরের মতে, আমপান-ক্ষতিপূরণের অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাতে মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি তা স্বীকার করে পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। করোনা ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় সমস্যার কথাও উঠেছিল এ দিনের বৈঠকে। মুখ্যমন্ত্রী ফের আবেদন করেছেন, করোনা ও অন্য রোগের চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালকেই একই রকম নজর দিতে হবে। চিকিৎসার অভাবে কেউ যেন বিপন্ন না হন।
এক মাস আগে আপমান-তাণ্ডবের কয়েক দিন পরেই ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তার পরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা নিয়ে জেলায় জেলায় অভিযোগ উঠতে শুরু করে। কোথাও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বাদ দিয়ে শাসক দলের পদাধিকারীগের ক্ষতিপূরণ নিয়ে নেওয়া, কোথাও অর্থের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার অভিযোগ এসেছে। নানা জায়গায় বিক্ষোভ চলেছে এ দিনও। কয়েক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা বঞ্চিত হলে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নেবে সরকার। কিন্তু তার পরেও অভিযোগ বন্ধ হয়নি। সর্বদল বৈঠকে আলোচনার পরে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমপানের কিছু কিছু সমস্যা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে, কেউ কেউ বঞ্চিত হয়েছেন। কোনও মানুষের বঞ্চনা আমাদের সরকার সহ্য করবে না। বিডিও কার্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। কোনও মানুষের নাম তাতে নেই— তেমন অভিযোগ পেলে বিডিও সেই ব্যাপারটা সরকারের নজরে আনবেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, ‘‘দলবাজি প্রশ্রয় দেওয়ার জায়গা নেই। যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা দরখাস্ত করতেই পারেন। ২১০০ কেস এসেছে আমার কাছে। সেগুলি দেখতে বলেছি।’’
সর্বদলে সিদ্ধান্ত
• আমপানে ক্ষতিপূরণের দাবিতে কেন্দ্রের কাছে সর্বদলীয় প্রস্তাব
• খসড়া করবে সর্বদল কমিটি
• আমপান-ক্ষতিপূরণে বঞ্চিতদের তালিকা
সাত দিনের মধ্যে
• উপভোক্তাদের নাম টাঙানো হবে বিডিও অফিসে
• প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করবেন বিডিও, জেলাশাসকেরা
• ক্ষতিপূরণের আবেদন সাদা কাগজেও করা যাবে
• অসংগঠিত, পরিযায়ী এবং হকারদের নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা
• কোভিড এবং অন্য রোগের চিকিৎসায় সমান গুরুত্ব
• কোভিড-যুদ্ধ একত্রে লড়তে হবে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ, সুজন চক্রবর্তী, প্রদীপ ভট্টাচার্যদের নিয়ে একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারা খসড়া প্রস্তাব তৈরি করবে। সেই প্রস্তাব রাজ্য সরকার গ্রহণ করে তা কেন্দ্রকে পাঠানো হবে। আমপানের ক্ষতিপূরণ, সুন্দরবনের জন্য স্থায়ী মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য নীতি আয়োগে আবেদন করা, অসংগঠিত, পরিযায়ী শ্রমিক ও হকারদের জন্য নীতি নির্ধারণ এবং কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদল প্রস্তাব তৈরি করা হবে। মমতা বলেন, ‘‘হার্দিক পরিস্থিতিতে আলোচনা হয়েছে বিস্তারিত ভাবে। আমপানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সর্বমত হয়েছে। দিলীপবাবুর দল (বিজেপি) রয়েছে। তাঁদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। তবে সকলের মত নিয়েই খসড়া প্রস্তাব তৈরি হবে।’’
আরও পড়ুন: ধর্ষণের চেষ্টা মেয়েকে, ধাক্কায় মায়ের মৃত্যু
বৈঠকের পরে বাম পরিষদীয় নেতা সুজনবাবুর দাবি, ‘‘আমপানের ত্রাণ নিয়ে দলবাজি ও দুর্নীতি হয়েছে, তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য সরকার। আমরা বলেছি, পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হোক।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবুর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় দল এসেছিল। ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে সাহায্য করা হবে। পার্থবাবুর নেতৃত্বে কমিটি হয়েছে। তার কাজ শুরু হলে বলতে পারব, কেমন কাজ হচ্ছে!’’ কংগ্রেসের প্রদীপবাবু বলেছেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হচ্ছে। কোভিড ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য আরও হাসপাতাল, আরও পরীক্ষাকেন্দ্রের কথা বলেছি।’’ মুখ্যমন্ত্রীও পরে বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলির জন্যও রূপরেখার প্রস্তাব এসেছে বৈঠকে। যেখানে নেই, সেখানে কোভিড পরীক্ষাকেন্দ্র খোলা হবে। আরও তিন কোটি মাস্কেরও বরাত দিচ্ছে রাজ্য।