রাজধানী এক্সপ্রেস: আগ্রহ দেখাননি কুর্সিতে, তবে মমতার নজরে দিল্লি

একুশের শহিদ-স্মরণ মঞ্চ। আর সেই মঞ্চ থেকেই স্থির চোখ রইল ২০১৯-এর দিকে। বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের পর থেকেই তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনকী সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও তাঁর নাম তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ।

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস ও সঞ্জয় সিংহ

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪৫
Share:

জনারণ্য। ২১শে-র সমাবেশে মানুষের ঢল। বৃহস্পতিবার ধর্মতলা চত্বরে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

একুশের শহিদ-স্মরণ মঞ্চ। আর সেই মঞ্চ থেকেই স্থির চোখ রইল ২০১৯-এর দিকে।

Advertisement

বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের পর থেকেই তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমনকী সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও তাঁর নাম তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ। ব্যাপারটা যে নিছক জল্পনা নয়, এ বার তা বুঝিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। বৃহস্পতিবার একুশের মঞ্চ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা তাঁর না থাকলেও আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।

বস্তুত একটি নির্বাচন উতরে যাওয়ার পরেই পরবর্তী ভোটের ‘টার্গেট’ বেঁধে দেওয়া মমতার বরাবরের অভ্যাস। বৃহস্পতিবার শহিদ সমাবেশের থই থই ভিড়ের আকাঙ্খা ছিল, বিপুল জয়ের পরে দিদির মুখে নতুন কথা শোনার। তা ছাড়া মমতার আগে বলতে উঠে মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীরা বলে দিয়েছিলেন, ‘‘তৃণমূলের সামনে লক্ষ্য এখন একটাই— ২০১৯ সালে দিল্লিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পৌঁছে যাওয়া।’’ সেই আবহেই মমতা এ দিন বলেন, ‘‘অনেকে বলছেন, মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে চায়। না না, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। বাংলায় কুঁড়ে ঘরে সুখে থাকতে চাই।’’ এক নিঃশ্বাসে এর পরেই তিনি জানান, ‘‘তবে হ্যাঁ,আঞ্চলিক রাজনীতিতে আমার বন্ধুরা রয়েছেন। ওঁদের এগিয়ে দিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে চাই আমি।’’

Advertisement

তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনীতির এই রূপরেখা জানানোর সঙ্গে তাল মিলিয়েই এ দিন মোদী সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন মমতা। নিশানা করেন বিজেপির বিভাজন ও বৈষম্যের রাজনীতিকেও। সেই সুর এতই চড়া ছিল যে, তার তুলনায় বাম-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এ দিন তাঁর সমালোচনা ছিল দৃশ্যত ফিকে! মমতার এই কৌশলের নেপথ্যেও জাতীয় রাজনীতির সমীকরণটাই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

তৃণমূলের এক সহ-সভাপতির বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার নামে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে মমতার সখ্য বাড়ানোর প্রয়াস নতুন নয়। প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তিনি এটা শুরু করছেন। নীতীশ কুমার, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়েক, মুলায়ম সিংহদের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা ক্রমশ বাড়িয়েছেন। ওই নেতার কথায়, ‘‘গত লোকসভা ভোটে এই আঞ্চলিক নেতাদের সমষ্টিগত আকাঙ্খা মোদী-ম্যাজিকে ধাক্কা খেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্য দিক থেকে নতুন সুযোগও এনে দিয়েছে। কেন না ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের প্রধান খুঁটি কংগ্রেস জাতীয় স্তরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নীতীশ-মমতাকে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে সে জন্যই।’’

তৃণমূল নেতৃত্বের মতে, সন্দেহাতীত ভাবেই সে দিক থেকে জাতীয় স্তরে মমতার সামনে চ্যালেঞ্জ এখন একজনই। নরেন্দ্র মোদী। তাই একুশের মঞ্চ থেকে এ দিন রাজনৈতিক ভাবে মোদী বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছেন মমতা। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর অভিযোগ করে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘ওদের হাতে একটাই অস্ত্র রয়েছে। সিবিআই। কিছু হলেই হয় সিবিআই পাঠাচ্ছে, নয় ইডি। আর এই অত্যাচারেই অতিষ্ঠ হয়ে আশি হাজার শিল্পপতি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন!’’ একই ভাবে বিভিন্ন প্রকল্প খাতে বরাদ্দ কমানো নিয়েও মোদী সরকারের সমালোচনা করেন মমতা। সেই সঙ্গে একশো দিনের কাজ বা কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কাজ করছে রাজ্য, আর তা ভাঙিয়েই এখন নাম কিনতে চাইছে কেন্দ্র!’’ গুজরাতে দলিতদের ওপর অত্যাচার এবং দেশে বিভাজনের রাজনীতি নিয়েও বিজেপিকে তুলোধনা করেন মমতা। নাম না করে বিজেপির উদ্দেশে বলেন, ‘‘ছাগল খেলে দোষ নেই, গরু খেলেই দোষ। কে কী পরবে, কী খাবে তা তোমরা ঠিক করে দেওয়ার কে?’’

বিজেপির বিরুদ্ধে এত চড়া সুরের পাশে তাঁর মুখে বাম-কংগ্রেসের সমালোচনা ছিল কার্যত মৃদু। অনেকের মতে, এমন নয় যে রাজ্যস্তরে কংগ্রেস বা বামেদের মমতা ছেড়ে কথা বলবেন। বরং আগামী কয়েক মাসে বিরোধী শিবিরে আরও ভাঙন ধরানোর জন্য দলে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সম্পর্কে কৌশলগত কারণেই নীরব মমতা। কারণ তিনি জানেন, কেন্দ্রে আঞ্চলিক শক্তির নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গড়তে গেলে কংগ্রেসের সমর্থন অপরিহার্য। ফলে সেই দরজা খোলা রাখতেই হবে।

এ দিন যে ভাবে বিজেপিকে নিশানা করেছেন মমতা, তাতে অশনিসংকেত দেখছেন অধীর চৌধুরী-সূর্যকান্ত মিশ্ররা। তাঁদের মতে, বাংলার রাজনীতি বিজেপির সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছেন মমতা। অর্থাৎ মেরুকরণে হাওয়া দিতে চাইছেন। তাই গরু-ছাগল-লুঙ্গির প্রসঙ্গ তুলেছেন। মমতা জানেন, মেরুকরণ হলে তাঁর সুবিধা। তার প্রমাণ গত লোকসভা ভোটে ৩৪টি আসনপ্রাপ্তি। বিজেপির প্রাক্তন বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘সচেতন ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী বিভাজনের রাজনীতি করছেন। ২০০৮-এ ফুরফুরা শরিফের বক্তৃতা থেকে আজ পর্যন্ত সেই বিভাজনের রাজনীতিই চালিয়ে গেলেন!’’

বিরোধীদের এই বক্তব্যে তৃণমূলের অবশ্য কিছু যায়-আসে না। বাস্তব হল, দিদি এখন আর শুধু বাংলার নয়, দিল্লিরও হয়ে উঠতে চাইছেন। নবান্নে বসেও তাঁর নজর দিল্লির উপরেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement