দার্জিলিং ম্যালে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত শিলিগুড়ির বাম কাউন্সিলর শঙ্কর ঘোষ। পাশেই অশোক ভট্টাচার্য। তাঁর ডান দিকে আরও দুই কাউন্সিলর মুকুল সেনগুপ্ত ও শরদিন্দু চক্রবর্তী। সঙ্গী মুকুলবাবুর মেয়ে অর্কমিতাও। সোমবার সন্ধ্যায়। ছবি: রবিন রাই।
মুখ্যমন্ত্রী পা রাখার মুখেই শিলিগুড়িতে যেন কলকাতা ময়দানে ফুটবলের দলবদলের আগের সেই পুরনো আবহ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পা রাখলেন সোমবার বিকেলে। কিন্তু তার আগে দুপুরে, বাম-পুরপিতাদের দু’জন ছাড়া বাকিদের তিনটি গাড়িতে নিয়ে শহর ছাড়েন মেয়র পদপ্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য। খুব কম সময়ের ফারাকে ছোট গাড়ি নিয়ে ডুয়ার্সের জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গিয়েছে পুরভোটে জয়ী নির্দল প্রার্থী অরবিন্দ ঘোষকেও (অমু)। পুরসভার বোর্ড গড়ার আগে এই ‘প্রস্থান’, বিশেষ ইঙ্গিতবাহী ঠেকেছে জেলা রাজনীতির নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের কাছে। মনে পড়িয়ে দিয়েছে, ষাট-সত্তরের দশকে ময়দানে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের নাম করা খেলোয়াড়দের এমন ভাবেই ‘লুকিয়ে রাখা’র প্রথা।
শিলিগুড়িতে ৪৭টি আসনের মধ্যে বামেরা ২৩। তৃণমূল পেয়েছে ১৭। কংগ্রেস চার, বিজেপি দুই এবং অরবিন্দবাবু। বোর্ড গড়তে প্রয়োজনীয় সমর্থন তাঁর তরফ থেকেই আসবে, সে আশা রয়েছে বামেদের অনেকের। তবে তৃণমূল বসে নেই। সমর্থন করার জন্য অন্য দলের বেশ কয়েকজনকে তৃণমূল নেতারা নানা ভাবে ‘টোপ দিচ্ছেন’ বলে শোনা যাচ্ছে। অরবিন্দবাবু তো বটেই, কয়েকজন বাম পুরপিতাকেও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও বাতাসে ভেসেছে। অরবিন্দবাবুর দাবি, এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। নানা লোভনীয় প্রস্তাব, সরকারি পদ নিয়ে দরাদরির কথাও কৌশলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হাওয়া যেখানে ‘এমন’, ঝুঁকি নেননি পোড় খাওয়া রাজনীতিক অশোকবাবু। মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়িতে পৌঁছনোর ঘণ্টাখানেক আগেই দলের বেশিরভাগ পুরপিতাদের নিয়ে সটান দার্জিলিঙে চলে গিয়েছেন তিনি। বাম শিবিরের দাবি, অরবিন্দবাবুর সঙ্গেও ঘণ্টায় ঘণ্টায় কথা হচ্ছে তাঁদের।
নেপালের কাঁকরভিটায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে
স্মারক তুলে দিচ্ছেন নেপালের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী নারায়ণ খড়কা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
তৃণমূল সূত্রের খবর, শিলিগুড়ির ধারাবিবরণী মুখ্যমন্ত্রীরও কানে গিয়েছে ঘণ্টায়-ঘণ্টায়। বিকেল ৩টে নাগাদ বাগডোগরায় নেমে তিনি নেপাল সীমান্তে গিয়ে ত্রাণের জন্য ৩৫টি ট্রাক রওনা করিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে উত্তরকন্যায় গিয়ে দলের জয়ী পুরপিতাদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, সেই সভাতেই অন্য দলের আরও অন্তত সাত জনকে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে হাজির করাতে মরিয়া ছিল দলের একাংশ। সেইমতো মুখ্যমন্ত্রীর অতিথি নিবাসের মিটিং-হলে চেয়ারও রাখা হয়েছিল ১৭টির অনেক বেশি। কিন্তু বিপক্ষ শিবিরের প্রায় পুরোটা, এমনকী, নির্দলও হাতের নাগালে নেই বুঝে তৃণমূলের অত্যুৎসাহীরা সাময়িক ভাবে রণে ভঙ্গ দেন।
দলনেত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে কী দাঁড়াল? তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের জবাব, ‘‘পুরপিতারা বৈঠক করে পরিষদীয় দলনেতা ঠিক করবেন। এর পরে পুর-আইন মেনে তাঁরা এগোবেন। বোর্ড গঠন নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ পুরভোটে জেতা দলের আর এক নেতা নান্টু পাল অবশ্য এখনও বলছেন, ‘‘মেয়র নির্বাচনে যোগ দেব কি না, তা নিয়েও শীঘ্রই আলোচনা হবে।’’ বোর্ড গড়ুন, না গড়ুন বামেদের এই ‘কৌশলই’ কি তা হলে তৃণমূলকে ‘অস্বস্তি’তে ফেলল? এ বার মুখে কুলুপ দুই নেতারই।
লাটাগুড়ি রওনা হওয়ার আগে শিলিগুড়িতে
নিজের বাড়িতে অরবিন্দ ঘোষ। ছবি: নিজস্ব চিত্র।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদু-অঙ্কে পৌঁছতে নিজের পক্ষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ‘লুকিয়ে রাখা’র ঘটনা অবশ্য আগেও ঘটেছে। ১৯৮৫ সালে কলকাতা পুরসভার ভোটে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের ব্যবধান ছিল সামান্য। বামফ্রন্ট কমল বসুকে এবং কংগ্রেস শিবকুমার খন্নাকে প্রার্থী করে লড়েছিল। রাজনৈতিক মহলে চাউর হয়, কংগ্রেসের দু’-এক জনকে বামফ্রন্ট নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত সুলতান আহমেদের ব্যবস্থাপনায় রিপন স্ট্রিট পাড়ার একটি হোটেলে কংগ্রেসের সমস্ত কাউন্সিলরদের রাখা হয়। যদিও ভোটাভুটির পরে দেখা যায়, যতটা ভোট দরকার ছিল, তার থেকে কয়েকটি বেশি পেয়ে কমল বসুই মেয়র হয়েছেন।
আবার কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৯০ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে কংগ্রেস চন্দ্রশেখরকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়। চন্দ্রশেখর সরকারও গড়েন। কিন্তু তার আগে নিজের পক্ষের সাংসদদের তিনি হরিয়ানায় তাঁর বিলাসবহুল আশ্রমে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। চরণ সিংহের মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে জনতা পার্টি ভাঙাভাঙির সময়ও সাংসদদের লুকিয়ে রাখা হয়েছিল হরিয়ানার সূরযকুণ্ডে।
শিলিগুড়ির ক্ষেত্রে কি পরিস্থিতি তেমনই ছিল? এক প্রবীণ বাম নেতার দাবি, ‘‘যা সব প্রস্তাব বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে মাথা ঘুরে যেতে পারে অপেক্ষাকৃত দুর্বলচিত্ত যে কারও। হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। তাতে পুরপিতা তো বটেই, তাঁর পরিবারও ঘাবড়ে যাচ্ছে।’’ ঘনিষ্ঠ মহলে তৃণমূলেরও কিছু নেতা-কর্মী মানছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের কথা জানাজানি হতে, তাঁর সামনে ‘নম্বর’ বাড়াতে গিয়ে দলের কিছু নেতা একটু ‘বেশিবেশি’ করে ফেলেছেন। তাতেই বাম শিবির ‘নাগালের বাইরে’ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকারের মন্তব্য, ‘‘পুরভোটে তৃণমূল-বিরোধী রায়ই দিয়েছে শিলিগুড়ি। তবু তারা বোর্ড গঠনে মরিয়া। বোঝাই যায়, ওরা যে কোনও মূল্যে সব কিছু দখল করতে চায়। তাই আমাদের পুরপিতাদের নিরাপদে রাখতেই হতো।’’
ফিরবেন কবে? হাসছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। অশোকবাবুর জবাব, ‘‘একটু ক্লান্ত ছিলাম বলেই সকলে মিলে বেড়াতে এসেছি। মঙ্গলবার বিকেলের দিকে (মুখ্যমন্ত্রীও কলকাতা ফিরছেন আজ বিকেলে) ফেরার ইচ্ছে রয়েছে। আমরা সকলে একজোট ছিলাম, আছি ও থাকব।’’ অরবিন্দবাবুও জানাচ্ছেন তিনিও ফিরছেন একই সময়। বলছেন, ‘‘পারিবারিক কাজে ডুয়ার্সে এসেছি। কিন্তু এটাও ঠিক, শিলিগুড়িতে কিছু লোক আমায় নানা ভাবে বিরক্ত করছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময়ে তাই আমার বাইরে থাকাই ভাল মনে হয়েছে।’’
বাম শিবির মনে করিয়ে দিয়েছে, তাদের দু’জন— প্রাক্তন মেয়র নুরুল ইসলাম ও সিপিএমের ডাবগ্রাম জোনাল কমিটির সম্পাদক দিলীপ সিংহ শিলিগুড়িতে রয়েছেন। নুরুলবাবুর স্ত্রী অসুস্থ, দিলীপবাবুর মাতৃবিয়োগ হয়েছে।
তৃণমূলের নেতাদের একটা বড় অংশ অবশ্য এ তথ্য জেনে ‘বাড়তি বল’ পাচ্ছেন না। তাঁদের হতাশা, ‘‘নুরুল ইসলাম, দিলীপবাবুকে আমাদের দিকে টানা যাবে না! ওঁরা শহরে থাকলেই বা কি! দিদির সামনে নাকটা কাটা গেল আমাদের!’’