মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফাইল চিত্র
একের পর এক সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে রাজ্য সরকার। চলতি আর্থিক পরিস্থিতিতে সেই সব প্রকল্পে খরচের বিপুল চাপ কী ভাবে সামলানো যাবে, তা নিয়ে প্রশাসনের অন্দরে জল্পনার অন্ত নেই। খরচ কমানোই যে নতুন খরচ জোগানোর একমাত্র পথ, বুধবার রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক মূল্যায়ন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অন্তত তিন জন মন্ত্রী এবং কিছু সচিবকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করে দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী এটা স্পষ্ট করে দেন যে, সব দফতরকেই খরচে রাশ টানতে হবে। সম্মিলিত ভাবে যে-পরিমাণ অর্থ সরকার বাঁচাতে পারবে, তা খরচ করা হবে সামাজিক ক্ষেত্রে। নবান্ন সূত্রের খবর, পূর্ত, সমবায়, দমকল ও সেচ দফতরের কাজ নিয়ে এ দিনের বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মমতা।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা কোভিড পরিস্থিতিতে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা আরও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, রাজস্ব আদায় থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে আদায় হওয়া করের ভাগ— কোনওটাই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না-পৌঁছনোয় সমস্যা বেড়েছে। এই অবস্থায় চলতি আর্থিক বছরের বাকি দিনগুলিতে সরকার কোন পথে চলবে, এ দিন তার একটা রূপরেখা স্থির করে দিয়েছেন মমতা। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় খরচ পুরো বন্ধ। নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ বা সংস্কার বাবদ খরচ থেকে আপাতত বিরত থাকতে হবে। গত প্রায় ১১ বছরে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে দফতরগুলিকে।
ইচ্ছামতো যখন-তখন প্রকল্পের পরিকল্পনা করে তার অনুমোদন চাওয়া যাবে না আপাতত। বিধায়ক, মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতারা হামেশাই সরকারের কাছে স্থানীয় স্তরে যে-সব প্রকল্পের ‘আবদার’ করে থাকেন, রাশ টানতে হবে তাতেও।
নবান্ন সূত্রের খবর, আলিপুরে একটি পরিকাঠামো নির্মাণকে ঘিরে এ দিন পূর্ত দফতরকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। বিচার বিভাগ থেকে পূর্ত দফতরের কাছে আদালত সংক্রান্ত একটি নির্মাণের প্রস্তাব আসে। পূর্ত দফতর তা অনুমোদন করে। মমতা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান, মন্ত্রিসভাকে না-জানিয়ে এই ধরনের নির্মাণ করা হচ্ছে কেন? পূর্তসচিব বলার চেষ্টা করেন, বিচার বিভাগ এই প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বিচার এবং পূর্ত দু’টি দফতরেরই মন্ত্রী মলয় ঘটক। তাই প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনিই। মমতা তাঁকে সতর্ক করে দেন। একটি ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্প নিয়ে সমবায় দফতরকেও চেপে ধরেন মমতা। সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়কে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, দফতরের অধীনে থাকা নিগম কোনও প্রকল্পে খরচ করলেও তা আখেরে সরকারেরই খরচ। বিধাননগরে নিজের নির্বাচনী এলাকার কিছু ক্লাবকে অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র দেওয়ার জন্য অর্থ দফতরে ফাইল পাঠিয়েছিলেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। এই নিয়ে তাঁকেও মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মার মুখে পড়তে হয় এ দিন।
“মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, পরিকাঠামো-সহ নানা খাতে রাজ্য বিপুল খরচ করেছে। এখন সামাজিক প্রকল্পে খরচ করার পালা। এমনিতেই সামাজিক খাতে
সরকারের খরচ অনেক বেশি। নতুন প্রকল্প হিসেবে লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু হওয়ায় খরচের বহর অনেকটাই বাড়বে। সেই জন্যই আর্থিক সংস্থানের বিকল্প রাস্তা খোলা রাখতে চাইছে রাজ্য,” বলেন বৈঠকে উপস্থিত এক কর্তা। পর্যবেক্ষক শিবিরের অনেকেই মনে করছেন, পরিকাঠামো ক্ষেত্রের খরচে রাশ টানলে স্থায়ী সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়া বা তার রক্ষণাবেক্ষণ ধাক্কা খেতে পারে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতির উপরেও। তবে প্রশাসনের অন্দরের বক্তব্য, পরিকাঠামো ক্ষেত্র সমস্যায় পড়তে পারে, এমন পদক্ষেপ সরকার করবে না। এক কর্তার কথায়, “বিগত প্রায় ১১ বছরে রাজ্যে সড়ক, উড়ালপুল, বাঁধের মতো পরিকাঠামোয় বিপুল বরাদ্দ হয়েছে। সেই সব স্থায়ী সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে কড়া নজর রয়েছে রাজ্যের। অতীতের বিভিন্ন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়েও দিয়েছেন, টাকা জলে যাবে, এমন কাজ করতে রাজি নয় সরকার।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বালি-পাথর ‘ওভারলোডিং’-এর সমস্যা নিয়েও এ দিন সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। স্থানীয় স্তরে পুলিশ এবং কিছু অফিসার যে অনৈতিক ভাবে বালি-পাথরের গাড়ি থেকে টাকা তুলছেন, সেই তথ্য নবান্নের কাছে আছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, আগামী দিনে এমন তথ্য পেলে সরকার কড়া পদক্ষেপ করবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এমন ‘অবৈধ’ পরিবহণে জরিমানার অর্থ সরকারের প্রাপ্য। সেই টাকা সরকারের হাতে এলে তা সামাজিক ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।