মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনার পথে ট্রেনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
প্রথম শ্রেণিতে ওঠানো গেল না তাঁকে। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে রেলযোগে সৈকতশহর বার্সেলোনায় পৌঁছলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় সময় রবিবার বিকেলে তিনি পৌঁছেছেন। স্পেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েকের অনুরোধ সত্ত্বেও ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে ওঠেননি তিনি। যাত্রা করলেন দ্বিতীয় শ্রেণিতেই। মঙ্গলবার বার্সোলোনায় মমতার শিল্প সম্মেলন। মাদ্রিদের কর্মসূচিতে সন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আশা, বার্সেলোনাতেও সম্মেলনে সাড়া মিলবে।
এমনিতে বার্সেলোনা শহর হিসেবে খানিক ‘নাকউঁচু’ বলেই পরিচিত। একটি ইউরোপীয় লাইফস্টাইল সাময়িকী সেই ২০১৭ সালেই লিখেছিল, সারা পৃথিবীতে কিছু শহর আছে, যারা পর্যটকদের ঘোরতর অপছন্দ করে। বার্সেলোনা তাদের মধ্যে অষ্টম স্থানে। অর্থাৎ, বেশ উঁচুর দিকেই। শহরের তৎকালীন মেয়র বলেছিলেন, ‘‘আমরা চাই না, ভেনিসের মতো এই শহরটাও একটা সস্তা স্যুভেনির শপ হয়ে উঠুক!’’
তখন থেকেই নতুন হোটেল এবং হলিডে অ্যাপার্টমেন্টের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ: ‘অতি পর্যটন সঙ্কট’। এমনিতেই বার্সেলোনা ইউরোপের অন্যতম জনবহুল শহর। তাই প্রশাসকেরা আর অতিরিক্ত পর্যটকের ‘বোঝা’ নিতে চান না। তাঁদের যুক্তি— অতিরিক্ত ভ্রমণবিলাসী এসে পড়লে শহরের আদত বাসিন্দারা অগ্রাধিকার পান না। কিন্তু তাঁরাই শহরের দীর্ঘমেয়াদি বাসিন্দা। তাঁদের জন্য, তাঁদের নিয়েই শহর। সেই প্রশাসনের বক্তব্যের নির্যাস— দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবসা করলে সেটা শহরের অর্থনীতিকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু শহরে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটক ঢুকে পড়ে ভিড় জমান। বার্সেলোনা সেই রকম একটা শহর হয়ে উঠেছে।
সারা বিশ্বে বার্সোলোনার পরিচয় অবশ্য পর্যটন নয়, ফুটবলের শহর হিসেবে। বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ধাত্রীগৃহ হিসেবে। তার চেয়েও অধুনা বেশি পরিচয় লিওনেল মেসির প্রাক্তন ক্লাব এবং প্রাক্তন বাসস্থান হিসেবে। হতে পারে স্পেন থেকে ফ্রান্স হয়ে মেসি এখন আমেরিকার ক্লাবে খেলছেন। কিন্তু বার্সেলোনাকে দুনিয়া এখনও চেনে ‘মেসির শহর’ হিসেবেই। মেসির দেশ আর্জেন্টিনা। সে দেশের হয়ে কাতার থেকে বহুকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপও জিতে ফিরেছেন তিনি। তবে মেসির সঙ্গে বার্সেলানার সম্পর্ক কী, তা জানে গোটা ফুটবল দুনিয়া। যে ছেলের কৈশোরেই পা থেকে ফুটবল চলে যেতে পারত, তাঁকে কার্যত মহাতারকা করেছে বার্সার আক্যাডেমি ‘লা মাসিয়া’। যা মেসিকে পুনর্জন্ম দিয়েছিল। সে দিক থেকে এই শহর ‘মেসির দেশ’ও বটে।
বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের জন্ম ১৮৯৯ সালে। বয়স এখন ১২৩ বছর। পৃথিবীর তৃতীয় মহার্ঘ স্পোর্টস টিম। রাজস্বের দিক থেকে সারা পৃথিবীর ফুটবল ক্লাবগুলির মধ্যে চতুর্থ। রেকর্ডসংখ্যক ট্রফি জিতেছে মেসির প্রাক্তন ক্লাব (৭৭টি)। এর মধ্যে ২৭ বার লা লিগা, ৩১ বার কোপা দেল রে, ১৪ বার সুপারকোপা দি এস্পানা। তার সঙ্গে রয়েছে ২২টি ইউরোপীয় এবং বিশ্ব ক্লাব পর্যায়ের খেতাব। বৃহত্তম ফুটবলতুতো শত্রু রিয়াল মাদ্রিদ (যে ক্লাবের স্টোডিয়ামে শনিবার গিয়েছিলেন মমতা এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়)। যে শত্রুতার ফসল ‘এল ক্লাসিকো’। অর্থাৎ, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের মহারণ।
রবিবার স্থানীয় সময় বিকেলে বার্সেলোনায় পৌঁছলেন মমতা। মাদ্রিদ থেকে সুপারফাস্ট ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে ওঠার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রাজি হননি। সাধারণ শ্রেণির কামরাতেই উঠলেন। সস্ত্রীক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং সফরসঙ্গী শিল্পপতিরা অবশ্য প্রথম শ্রেণিতেই সফর করেন। সন্ধ্যায় বার্সেলোনার প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মিলিত হবেন মুখ্যমন্ত্রী। মাদ্রিদেও প্রবাসী ভারতীয় ও বাঙালিদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন দিদি।
সোমবার মমতার কোনও পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। মঙ্গলবার বার্সেলোনায় শিল্প বৈঠক রয়েছে তাঁর। মমতার এই স্পেন ও দুবাই সফরের উদ্দেশ্যই রাজ্যে বিনিয়োগ টানা। সেই সঙ্গে বাংলার ফুটবলের উন্নতি। মাদ্রিদে লা লিগার সঙ্গে রাজ্য সরকারের ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার তাভেজ়ও। তিনিও জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই তারা বাংলায় অ্যাকাডেমির কাজ শুরু করবেন। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লা লিগার ফুটবল অ্যাকাডেমির জন্য যাদবপুর-সন্তাষপুরের কিশোর ভারতী স্টেডিয়াম তুলে দেওয়া হবে। শনিবার রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাবিউতে গিয়ে সেখানকার পরিকাঠামো ও বাণিজ্যিকীকরণ পরখ করে এসেছেন দিদি। লা লিগার সঙ্গে বৈঠক এবং রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবে সফর, দু’টি ক্ষেত্রেই মমতার সঙ্গী ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মাদ্রিদের লগ্নি-সম্মেলনেও ছিলেন সৌরভ।