রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামের বিপণনী থেকে সৌরভকে বল উপহার দিচ্ছেন মমতা। —নিজস্ব চিত্র।
ক্যাবিনেটে সাজানো সারিবদ্ধ ট্রফি। আলো পড়ে তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ইতিহাস। ১২১ বছরের ইতিহাস। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে তাদের দাপটের ইতিহাস। শনিবার দুপুরে রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাবিউতে পৌঁছে তা পরখ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিদির পাশে ছিলেন দাদা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। দেখলেন মিউজিয়াম, নবনির্মিত বিস্ময়-স্টেডিয়াম। গিয়ে বসলেন গ্যালারিতে। সেই সঙ্গে মমতা দেখলেন, ফুটবলের সঙ্গে বাণিজ্যকে মিশিয়ে বিপণনকে ঠিক কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
এই ক্লাবের সঙ্গে বিশ্ব ফুটবলের যত নাম, যত চরিত্র, যত সাফল্য জড়িয়ে রয়েছে তার প্রদর্শনী যদি না হয় তাহলে বোধহয় ইতিহাসের সঙ্গে কিছুটা অবিচার করা হতো। তা করেনি সান্তিয়াগো বার্নাবিউ। এই ক্লাবেই তো খেলে গিয়েছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার রোনাল্ডো। পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস থেকে ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী জিনেদিন জিদান, লুই ফিগো থেকে ডেভিড বেকহ্যামরা। কিংবা এখন সার্জিও রামোস থেকে লুকা মদ্রিচ কিংবা মার্সেলো— খেলেছেন, খেলছেন এই ক্লাবেই। এই মাঠেই। এই জার্সিতেই।
রিয়াল মাদ্রিদকে শুধু একটা ক্লাব বললে ভুল হবে, তা হল গোটা স্পেনবাসীর গর্ব এবং অহঙ্কার। ইউরোপের ক্লাব ফুটবল জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে একচ্ছত্র দাপট রয়েছে রিয়ালের। ইউরোপিয়ান কাপ (অধুনা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) পর পর পাঁচ বার জিতেছে রিয়াল। তখন আলফ্রেডো ডি’স্টিফানোদের দাপট। এর পর কিছুটা খুচরোখাচরা সাফল্য। মাঝে কিছুটা সময় ভাটা। তবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, করিম বেঞ্জেমা, মদ্রিচদের হাত ধরে আবার গত ১০ বছরে রিয়ালের দাপট দেখা গিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামকরণ হওয়ার পর থেকে কোনও দল পর পর দু’বার ট্রফি জিততে পারেনি। রিয়াল টানা তিন বার জিতেছে। ইউরোপের ফুটবলে স্পেনের যে গরিমা, তা সম্ভব হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের হাত ধরেই। এ কারণেই কিলিয়ান এমবাপের মতো আধুনিক যুগের উঠতি তারকা রিয়াল মাদ্রিদে খেলার জন্যে মুখিয়ে থাকেন।
উপরে ১৯২৭ সালের রিয়াল টিমের বুট। নীচে রিয়ালে খেলার সময়ে জিনেদিন জিদানের ব্যবহার করা বুট। —নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি সূচিতে বার্নাবিউতে যাওয়ার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু শুক্রবারই দিদি ঠিক করে ফেলেছিলেন, তিনি রিয়ালের হোম গ্রাউন্ড দেখতে যাবেন। স্টেডিয়ামে পৌঁছে কিছুটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী-সহ বাকিরা। তার পর এসক্যালেটরে পৌঁছে যান মিডল টায়ারে। এক স্পেনীয় তরুণী মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখাতে গাইডের ভূমিকায় ছিলেন।
দেওয়ালে ঝোলানো বিভিন্ন বছরের রিয়াল দলের ছবি। তার পর কোন বছর লা লিগা, কোন বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোন বছর ইউরোপা ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে রিয়াল, সে সব ট্রফি দেখিয়ে দেন স্প্যানিশ তরুণী। এ-ও জানালেন, রিয়ালের ট্রফি ক্যাবিনেটে যেমন ফুটবল রয়েছে, তেমনই রয়েছে বাস্কেটবলের সাফল্যও। শেষ বার জেতা ইউরোপা ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফির সামনে বেশ খানিক ক্ষণ দাঁড়ায় টিম-দিদি।
রিয়ালের মিউজিয়ামে ট্রফি ক্যাবিনেটের সামনে মমতা। —নিজস্ব চিত্র।
তার পর সোজা চলে যান গ্যালারিতে। স্টেডিয়ামটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। গ্যালারিতে আসার আগে সংগ্রহশালায় রাখা স্টেডিয়ামের প্রকাণ্ড রেপ্লিকাও দেখেন মমতা, সৌরভরা। গ্যালারির চেয়ারে বসে মাঠ দেখেন দিদি। পাশে বসেছিলেন দাদাও। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেই নতুন মাঠে প্রথম ম্যাচ খেলেছে রিয়াল। নবকলেবরে সেজে ওঠা সেই স্টেডিয়ামের ছাদ প্রয়োজন মতো খোলা-বন্ধ করা যায়। শুধু তাই! মাঠও চলে যায় মাটির নীচে। স্টেডিয়ামটিকে যখন বাণিজ্যিক কারণে ভাড়া দেওয়া হবে, তখন পৃথক একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হবে। মাঠের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তাই তা ভাঁজ করে ঢুকে যাবে মাটির নীচে। সেখানে জল, অতিবেগনি রশ্মি দিয়ে সতেজ রাখা হবে ঘাস। নতুন সান্তিয়াগো বার্নাবিউতে এখন একসঙ্গে ৮৫ হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারেন। এখনও পর্যন্ত স্টেডিয়াম গড়তে খরচ হয়েছে ৮৯০ মিলিয়ন ইউরো বা ভারতীয় মুদ্রায় ৭৯২০ কোটি টাকা। স্টেডিয়ামটি সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি করতে খরচ হবে আনুমানিক ২ বিলিয়ন ইউরো বা ভারতীয় মুদ্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
বার্নাবিউর গ্যালারিতে মমতা, সৌরভ এবং মুখ্যসচিব দ্বিবেদী। —নিজস্ব চিত্র।
রিয়ালের বিপণি থেকে সৌরভকে একটি ফুটবল কিনে উপহার দেন মমতা। তার পর বলেন, ‘‘বাংলার রক্তে, ঘাসে, মাটিতে মিশে আছে ফুটবল, ক্রিকেট-সহ অন্যান্য খেলা। সব খেলার সেরা বাংলার ফুটবল। যখন বিশ্বকাপ হয়, তখন তো আমরা রাত জেগে মেসি, রোনাল্ডোদের খেলা দেখি। পেলেও এসেছিলেন আমাদের কলকাতায়।’’ সেই সঙ্গে মমতা জানান, রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামের চেয়ে যুবভারতী কিংবা ইডেনে অনেক বেশি লোক বসতে পারে। কিন্তু শনিবার যে তাঁর লক্ষ্য ছিল বার্নাবিউর পরিকাঠামো দেখা তা স্পষ্ট করে দেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিকাঠামো দেখতে এসেছিলাম। সেই সঙ্গে দেখে গেলাম কী ভাবে ফুটবলকে বাণিজ্যিক করে তুলেছে। এটা আমাদের কাছে নতুন ধারণা এবং আশা।’’
সৌরভ বলেন, ‘‘এখানে আসতে পেরে আমার খুব ভাল লাগছে। আমি এর আগে রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখলেও, এই মাঠে আসিনি। মুখ্যমন্ত্রী লা লিগার সঙ্গে একটি ‘মউ’ স্বাক্ষর করেছেন। আশা করি তা বাংলার ফুটবলের জন্য কার্যকরী হবে।’’ রিয়ালের স্টেডিয়াম থেকেই সৌরভ স্ত্রী ডোনা, মেয়ে সানাকে নিয়ে বিমানবন্দরে চলে গেলেন সৌরভ। তিনি যাবেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকেই মাদ্রিদে এসেছিলেন দাদা। রবিবার মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনার উদ্দেশে রওনা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী।