—ফাইল চিত্র।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি। মানুদা, মানে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। আমি যোগমায়া দেবী কলেজে ছাত্র পরিষদ করি। প্রিয়দার কাছে মানুদা জানতে চেয়েছিলেন, ‘মমতা মেয়েটি কে? তুমি চেন?’ আমার নাম হয়তো কোনও ভাবে মানুদার কানে পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রিয়দা তখনও আমাকে চিনতেন না। কয়েক দিন পরে দক্ষিণ কলকাতা ছাত্র-যুব কংগ্রেসের একটি সম্মেলন হল। পার্থ রায়চৌধুরী তখন জেলা যুব কংগ্রেসের সভাপতি। সেখানেই পার্থদার কাছে প্রিয়দা আমার খোঁজ করেন। আমাকে ডেকে পার্থদা পরিচয় করিয়ে দেন প্রিয়দার সঙ্গে।
তার পর এতগুলো বছর প্রিয়দাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে দল করেছি। আবার বিভিন্ন ঘটনাচক্রে রাজনীতির মঞ্চে পরস্পরের বিরোধিতাও করেছি। মতান্তর হয়েছে অনেক সময়ে। মনান্তর বা ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় কখনও ধরেনি। প্রিয়দা আমাকে বরাবর ব্যক্তিগত ভাবে স্নেহ করেছেন। আমিও ব্যক্তি প্রিয়দাকে কোনও দিন অসম্মান করিনি।
আরও পড়ুন: আর আসবেন না দাদা, কান্নায় কৃষ্ণ
আমি রাজনীতিতে আসার অনেক আগেই প্রিয়দা প্রতিষ্ঠিত নেতা। ১৯৭১-এর ভোটে বাম-প্রার্থী গণেশ ঘোষকে হারিয়ে প্রিয়দা প্রথম সাংসদ হন। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর জয়ের খবরের শিরোনাম ছিল, ‘২৬ বছর বয়স, ২৬ হাজার ভোটে জয়’। খবরটি পড়ে আকৃষ্ট হয়েছিলাম প্রিয়দার প্রতি। আরও কিছুদিন পরে ছাত্র-রাজনীতিতে তাঁর নেতৃত্বে কাজও করি।
প্রিয়দার কথা বলতে গেলে সুব্রতদার (মুখোপাধ্যায়) কথাও বলতে হয়। প্রিয়দা, সুব্রতদা সেই সময়ে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত দু’টি নাম। প্রিয়দার কাছেই সুব্রতদারও রাজনীতির শুরু। কিন্তু ইন্দিরা গাঁধীর বিরোধিতা করে প্রিয়দা যখন কংগ্রেস(স)-তে চলে যান, সুব্রতদা তাঁর সঙ্গে যাননি। আমিও কংগ্রেসের মূল স্রোতেই ছিলাম। ফলে প্রিয়দার সঙ্গে যোগাযোগ কমে।
পরবর্তী কালে রাজনীতির বিভিন্ন আবর্তে প্রিয়দা কখনও আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। কখনও দাঁড়াননি। বরং যথেষ্ট বিরোধিতাই করেছেন। তবু আবারও বলব, সে সব কোনও কিছুই আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে ছায়া ফেলতে পারেনি।
বেঁচে থেকেও প্রিয়দা জীবন্মৃত হয়ে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। বেঁচে থাকার সান্ত্বনাটুকু ছিল, জীবনের উন্মাদনা ছিল না। সেই সময়ে বারবার তাঁকে দেখতে গিয়েছি। তাঁর ভাই-বোনদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো। প্রিয়দার ভাই সত্যদাকে আমি রায়গঞ্জে তৃণমূলের প্রার্থীও করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করতাম, এটা প্রিয়দার সিপিএম-বিরোধী মানসিকতার প্রতি পূর্ণ মর্যাদা-প্রকাশ।
বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর শেষ জীবনটা বড় দুঃখজনক। প্রিয়দা অসুস্থ হয়ে পড়ার অল্প দিন আগেই সুব্রতদা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘জানিস মমতা, প্রিয়দা ঠিকমতো ওষুধপত্র খাচ্ছে না। ডাক্তারি বিধিনিষেধও ঠিক ভাবে মানা হচ্ছে না। এটা খারাপ হচ্ছে।’’ তার পরেই প্রিয়দা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ভাবতে খারাপ লাগে, একটা রাজনৈতিক জীবন এত বছর নিশ্চল হয়ে রইল! প্রিয়দার কি এটা প্রাপ্য ছিল?