তৃপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
কার পাল্লাটা ভারী হল শেষমেশ, তা নিয়ে জোর তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। দু’পক্ষই দাবি করছে, নৈতিক জয় তাদেরই। কিন্তু দিন তিনেকের ধর্নায় ইতি টানার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেললেন নিঃসন্দেহে। ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড ময়দান থেকে যে বৃত্তটা আঁকতে শুরু করেছিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন, ৫ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় মেট্রো চ্যানেলে এসে সেই বৃত্তটা পূর্ণতা পেল। মোদী বিরোধী ব্রিগেডের সবচেয়ে আগুয়ান কম্যান্ডার হিসেবে নিজেকে গোটা দেশের সামনে প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন তিনি।
ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন পরিস্থিতিটার সূত্রপাত ঘটেছিল ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় লাউডন স্ট্রিট থেকে। সিবিআই আর কলকাতা পুলিশের মধ্যে বেনজির সঙ্ঘাতের সাক্ষী হয়েছিল কলকাতা। কিন্তু সঙ্ঘাতটা যে আসলে সিবিআই আর পুলিশের নয়, তা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য, আর পরিষ্কার করে বললে— বিজেপি ও তৃণমূল।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ধর্না উঠে যেতেই বিজেপি-তৃণমূলের সেই টানাপড়েনে ইতি পড়ল, এমনটা ভাবলে খুব ভুল হবে। টানাপড়েনের প্রথম পর্বটা শেষ হল মাত্র। আর সেই প্রথম পর্বের শেষে দু’পক্ষই দাবি করতে শুরু করল যে, সুপ্রিম কোর্টে জয় তাদেরই হয়েছে।
চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে ধর্নার মঞ্চে মমতা।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: কলকাতার ধর্না তুলে মমতার ঘোষণা, এবার ২ দিনের ধর্না দিল্লিতে
মঙ্গলবার সকাল ১১টার সামান্য আগেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের খবর পৌঁছয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। কালক্ষেপ না করে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন তিনি, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে জোর গলায় স্বাগত জানান এবং বলেন এই রায়ে তাঁরই জয় হল। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে আপাতত গ্রেফতার করা যাবে না বলে যে নির্দেশ সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে, তাতে নিজের জয় দেখতে পেয়েছেন মমতা। আদালত অবমাননা সংক্রান্ত অভিযোগের শুনানি সুপ্রিম কোর্ট এ দিন গ্রহণ না করায় নিজের জয় দেখতে পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজীব কুমারকে সিবিআই-এর সামনে হাজির হতে হবে বলে যে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে, নিজের মতো করে তারও একটি ব্যাখ্যা দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘সিবিআই-এর সামনে রাজীব কুমারকে হাজির হতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। সিবিআই এবং রাজীব কুমার কোনও একটা নিরপেক্ষ জায়গায় পরস্পরের সঙ্গে দেখা করবে— সুপ্রিম কোর্ট এটাই বলেছে। আমরাও এটাই চেয়েছিলাম। একটা মিউচুয়াল জায়গায় দেখা করতে চেয়ে রাজীব কুমার আগেই চার-পাঁচটা চিঠি দিয়েছেন।’’ মিডিয়ার একাংশে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপব্যাখ্যা হচ্ছে বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন অভিযোগ তোলেন।
কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি-ও স্বাগত জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়কে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে দাবি করেন যে, এই রায় আসলে সিবিআই-এর জয়। রায় হাতে পাওয়া মাত্র নতুন দল গঠন শুরু করে দেয় সিবিআই, যে দল রাজীব কুমারকে জেরা করবে।
ধর্নার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা তেজস্বী যাদবের।—নিজস্ব চিত্র।
কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতা সেখানেই শেষ হয়নি। রাজ্যপালের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। গোটা সঙ্কটটা নিয়ে রাজ্যপাল বেশ কড়া রিপোর্টই দিয়েছেন বলে খবর। তার পরে মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে চিঠি এসেছে রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে। কেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার ধর্নায় বসলেন? এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রাজীব কুমার সার্ভিস রুল ভেঙেছেন বলে ওই চিঠিতে লেখা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে বেশ ফুরফুরে রাখার চেষ্টাই করছিলেন দিনভর। কিন্তু সন্ধ্যায় ধর্না তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করার আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠির কথা তাঁর কানে পৌঁছয়। ধর্না প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করার সময়ে সে প্রসঙ্গ নিজেই উত্থাপন করেন তিনি এবং ফের ফুঁসে ওঠেন। রাজীব কুমার ধর্নায় সামিল হননি, সামিল হননি, সামিল হননি— বলেন তিনি। কেন্দ্রের ওই চিঠিকে যে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না, তা-ও বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন।
অর্থাৎ এক দিকে তিন ধরে মেট্রো চ্যানেলে চলল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্না। অন্য দিকে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে টানাপড়েনটাও সমানতালে চলল তিন দিন ধরে। ধর্না উঠে যাওয়ার মুহূর্তেও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সঙ্ঘাতে ইতি এখনই নয়। কারণ এক দিকে ইঙ্গিত মিলতে শুরু করল যে, রাজীব কুমারকে নানা দিক দিয়ে ঘিরে ফেলার তোড়জোড় করছে কেন্দ্র। অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’র পক্ষ থেকে চন্দ্রবাবু নায়ডু স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে, ধর্না আপাতত শেষ করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করছে ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার ছাতার তলায় থাকা সব দল। কিন্তু লড়াই থামছে না, এই লড়াই এ বার দিল্লি যাচ্ছে, যুক্তিযুক্ত উপসংহারে না পৌঁছনো পর্যন্ত এ লড়াই চলবে।
যে রাজীব কুমারের বাড়ির সামনে সিবিআই পৌঁছতেই কেন্দ্রকে তীব্র গর্জন শুনিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিন দিনের ধর্না শেষ সেই রাজীব কুমার কতটা স্বস্তিতে, তা নিয়ে প্রশ্ন রইল ঠিকই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই তিন দিনে জাতীয় রাজনীতির আরও উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হলেন। জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী রাজনীতির পুরোভাগে থাকতে যে তিনি প্রস্তুত, সে বার্তা অনেক দিন ধরেই দিচ্ছিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। কংগ্রেসকেই বিজেপি বিরোধিতার নেতা হিসেবে সর্বদা মেনে নিতে হবে, এই তত্ত্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। প্রয়োজনে কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই বিজেপি বিরোধী ঐক্যের কথা ভাবার প্রস্তাব নিয়েও তিনি জাতীয় স্তরে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছিলেন। তার পরে ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশে দেশের প্রায় সব প্রান্ত থেকে মোট ২৩টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হাজির করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, মোদী বিরোধী ব্রিগেডের অন্যতম কম্যান্ডার এখন তিনিই। ব্রিগেডের সেই মঞ্চে প্রতিনিধি পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল কংগ্রেসও। ফলে মমতার হাসি আরও চওড়া হয়েছিল। কিন্তু ব্রিগেডের ওই সমাবেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী শিবিরের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। ব্রিগেড থেকে ফিরে গিয়ে একে একে অনেকেই বলেছিলেন, বিজেপি বিরোধী জোটের নেতা রাহুল গাঁধীই। কিন্তু দিন তিনেকের এই ধর্না অনেকটাই বদলে দিল পরিস্থিতি। জাতীয় স্তরের বিরোধী রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন।
মূল আকর্ষণ সেই মমতাই।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: ৮ ফেব্রুয়ারি শিলংয়ে হাজির হতে পারেন, সিবিআইকে চিঠি রাজীব কুমারের
নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন বা সুর চড়াচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সঙ্গে এমন বেনজির সঙ্ঘাতে যাওয়ার সাহস এখনও পর্যন্ত কেউ দেখাননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সাহসটা দেখালেন। বেপরোয়া ভঙ্গিতে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নেমে পড়লেন। সে যুদ্ধে গোটা দেশের বিজেপি বিরোধী শিবিরকে মমতা নিজের পাশে পেলেন। রাজ্য কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খোলাখুলি সমর্থন করতে রাহুল গাঁধী বাধ্য হলেন। দু’দিন ধরে গোটা দেশের রাজনৈতিক শিবির থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন পেলেন। তেজস্বী যাদব, কানিমোঝি, চন্দ্রবাবু নায়ডুরা ধর্নামঞ্চে হাজির হয়ে ঐক্যের বার্তা দিলেন। ধর্না প্রত্যাহারও করলেন ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার প্রায় সবক’টি দলের কাছ থেকে অনুরোধ আসার পরেই। অতএব ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে যে ধুন্ধুমার পর্বটা শুরু হয়েছিল, ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তা যখন শেষ হল, তখন মোদী বিরোধী সংগ্রামের ব্যাটন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই।
ধর্না শেষ হল, কিন্তু লড়াই নয়— মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মেট্রো চ্যানেলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে একযোগে এ কথা ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চন্দ্রবাবু নায়ডু। পরের সপ্তাহে দিল্লিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজিত হচ্ছে বলেও তাঁরা ঘোষণা করেছেন। তেজস্বী ভাষণে লালুপ্রসাদের ছেলে এ দিন বলে গিয়েছেন, ‘‘মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একটা মজবুত পদক্ষেপের দরকার ছিল। সেই পদক্ষেপটা মমতাজি-ই করতে পারলেন, এ জন্য তাঁকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ।’’ আর পোড় খাওয়া চন্দ্রবাবু বেশ ইঙ্গিতবহ ভঙ্গিতে বলে গেলেন— জাতীয় রাজনীতির নির্ণায়ক হয়ে উঠতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।