দেগঙ্গার সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফেসবুক।
২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সাংগঠনিক সংস্কার’ শুরু হয়েছিল। একাধিক বড় জেলাকে একাধিক সাংগঠনিক জেলা কমিটিতে ভেঙে দিয়েছিল বাংলার শাসকদল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই সেই কাজ শুরু হওয়ায় দলের অনেকেই তাকে ‘অভিষেক মডেল’ বলে অভিহিত করতেন। লোকসভা ভোটের আগে কি সেই মডেল থেকে আবার পুরনো মডেলে ফিরতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
বৃহস্পতিবার উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় দলের কর্মিসভা থেকে ওই জেলায় নতুন করে কোর কমিটি গঠন এবং তার মাথায় চেয়ারম্যান হিসেবে নির্মল ঘোষকে বসিয়ে দেওয়ার পর শাসকদলের সর্ব স্তরেই এই মর্মে জল্পনা তৈরি হয়েছে যে, দিদি কি সংগঠনকে পুরনো মডেলে ফেরাতে চাইছেন? এবং তার শুরুটা হল উত্তর ২৪ পরগনা দিয়েই?
তৃণমূলের অন্দরে পুরনো মডেল বা ‘মমতা মডেল’ মানে একটি জেলায় একটিই কমিটি এবং এক জন জেলা সভাপতি। সেই জেলা সভাপতিই আসলে সংশ্লিষ্ট জেলার শীর্ষনেতা। যেমন উত্তর ২৪ পরগনায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় শোভন চট্টোপাধ্যায় বা শুভাশিষ চক্রবর্তী, হাওড়ায় অরূপ রায়, বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল, হুগলিতে তপন দাশগুপ্ত বা দিলীপ যাদব। তাঁরাই ছিলেন জেলায় ‘শেষ কথা’। কিন্তু উপরে উল্লিখিত সব ক’টি জেলাকেই একাধিক জেলায় ভেঙে তাদের এলাকা ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। যাকে অনেকে বলেছিলেন সাংগঠনিক কাঠামোয় ‘বিকেন্দ্রীকরণ’। অনেক বেশি লোককে নেতৃত্বের স্তরে তুলে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। তবে ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন বীরভূম জেলাকে কোনও দিনই একাধিক সাংগঠনিক জেলায় ভাঙা হয়নি। ভাঙা হয়নি আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের মতো ছোট জেলাকেও। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংগঠনিক জেলায় সংগঠনকে বিস্তার করার পথে হেঁটেছিলেন অভিষেক।
বৃহস্পতিবার মমতা যে ঘোষণা করেছেন, তাতে অনেকেই মনে করছেন, সংগঠনে নতুন ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন দলের সর্বময় নেত্রী। উত্তর ২৪ পরগনার এক নেতার কথায়, ‘‘কমিটি গড়ে দিদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি তিনটি-চারটি কমিটির জটিলতার মধ্যে যেতে চান না। আগে যে ভাবে জেলা চলত, সে ভাবেই চলবে।’’ রাজ্য তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘এই কোর কমিটি গঠন ও তার মাথায় চেয়ারম্যান হিসেবে এক জনকে বসিয়ে দেওয়ার অর্থ খুব স্পষ্ট। জেলায় যে চারটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি ছিল, সেগুলির আর কার্যত কোনও গুরুত্ব রইল না। জেলা সভাপতিরাও চলে গেলেন কোর কমিটির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের অধীনে।’’ প্রসঙ্গত, উত্তর ২৪ পরগনার যে চারটি সাংগঠনিক জেলা গঠিত হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে তিনটির সভাপতিকে কোর কমিটিরও সদস্য করেছেন মমতা। তাঁরা হলেন তাপস রায়, হাজি নুরুল ইসলাম এবং বিশ্বজিৎ দাস। কিন্তু তাঁদের মাথায় থাকবেন নির্মল। বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তথা বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে মমতা কোর কমিটিতে রাখেননি। তবে কোনও সাংসদকেই মমতা কোর কমিটিতে রাখেননি। তাঁদের বলা হয়েছে নিজেদের লোকসভা কেন্দ্রে বেশি সময় দিতে। সূত্রের খবর, মমতার ‘আশ্বাস’ পেয়েছেন ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহও।
বিষয়টি আরও নজরে পড়েছে কোর কমিটির মাথায় এক জনকে চেয়ারম্যান করে নিয়োগ দেওয়ায়। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, জ্যোতিপ্রিয় ওরফে বালু গ্রেফতার হওয়ার পরে মমতা একটি কোর কমিটি গড়েছিলেন। কিন্তু তার কোনও ‘চেয়ারম্যান’ ছিল না। এ বার পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ওরফে নান্টুকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যিনি জেলার রাজনীতিতে ‘বালু-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত।
তবে তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, এই ‘মডেল’ উত্তর ২৪ পরগনায় হল মানেই সব জেলায় হবে, তেমন কোনও কথা নেই। কারণ, উত্তর ২৪ পরগনার সংগঠন নিয়ে তৃণমূলে দীর্ঘ দিন ধরেই নানাবিধ কথা চলছে। বালু গ্রেফতার হওয়ার পরে জেলায় এক দিকে যেমন নেতৃত্বের মধ্যে ‘তুই বড় না মুই বড়’ শুরু হয়েছিল, তেমনই বিস্তীর্ণ অংশে ‘অভিভাবকহীনতা’ও কাজ করছিল। মমতা হয়তো প্রাথমিক ভাবে সেগুলিই রুখতে চেয়েছেন।
তবে অনেকের মতে, মমতার এই সিদ্ধান্ত তৃণমূলে নতুন মন্থন তৈরি করতে পারে। ‘অভিষেক মডেলে’ সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়া নেতাদের মধ্যে উদ্বেগেরও জন্ম দিতে পারে বলে অভিমত ওই অংশের। তবে সম্প্রতি নবীন-প্রবীণ, বয়সবিধি ইত্যাদি নিয়ে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরে যে মতের বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত তাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই মনে করছেন দলের প্রথম সারির অনেক নেতা। এখন দেখার বিষয়, এই ‘মমতা মডেল’ কেবল সন্দেশখালি থেকে সল্টলেক পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকে? না কি তা অন্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে!