মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
ভোটের মুখে এলাকা ফাঁকা করে বিজেপিকে সুবিধা দিতেই সিবিআই, ইডি তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতার করছে বলে অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের ভয়ে ওরা (বিজেপি) কাঁপে! তাই ভাবছে, গ্রেফতার করলে এলাকা ফাঁকা হয়ে যাবে আর বিজেপি ডুগডুগি বাজাবে!’’ সেই সূত্রেই তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘অত সোজা নয়। বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চিও জমি ছাডা হবে না!’’
দুর্নীতির তদন্তে দলের মন্ত্রী, বিধায়ক ও নেতাদের গ্রেফতারকে বরাবরই ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে চিহ্নিত করেছে তৃণমূল। শুধু তা-ই নয়, এই ‘প্রতিহিংসা’র মুখে প্রতিরোধের নমুনাও এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সন্দেশখালি ও বনগাঁয় তদন্তকারীদের উপরে হামলায় তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এ দিন একটি সরকারি মঞ্চ থেকে সেই ‘প্রতিহিংসা’র তত্ত্বে আরও এক বার সিলমোহর দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কয়লায় তৃণমূল, গরুতে তৃণমূল, সব কিছুতেই তৃণমূল। কারও কাপড়ে কালি লাগলেও বলবে তৃণমূল। দাড়ি পেকে গেলেও বলবে, তৃণমূল ( দায়ী)! আসলে তৃণমূলকে ওরা ভয় পায়। তাই তৃণমূলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, সাজিয়ে নেতা-নেত্রীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’’ বিজেপির প্রতি আঙুল তুলে মমতা বলেন, ‘‘মিথ্যা ভিডিয়ো বানিয়ে বিজেপি প্রচার করছে। আমাকে এ ভাবে আক্রমণ করলে মা-বোনেরা লড়াই করবেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পুলিশে ডায়েরি করুন। ব্যবস্থা নেব।’’ সন্দেশখালির ঘটনার উল্লেখ বা তার প্রেক্ষিতে তৃণমূলের নেতা শেখ শাহজাহানের নাম অবশ্য করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে সন্দেশখালির ঘটনার পরে ইডি-সিবিআইকে নতুন উদ্যমে তাঁর আক্রমণ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিরোধীরা অবশ্য শাহজাহান প্রসঙ্গে শাসক দলকে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় বিজেপির কর্মিসভায় গিয়ে এ দিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, ‘‘শাহজাহান কোথায় আমি জানি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বেড়মজুর-১ থেকে ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। অথচ পুলিশ জানে না! রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার শাহজাহানকে বলেছে আত্মসমপর্ণ করো।’’ বিরোধী দলনেতার ‘পরামর্শ’, ‘‘আমি শাহজাহানকে বলছি, আপনি ইডি’র কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সব স্বীকার করুন। আপনি রাজ্য পুলিশের কাছে ধরা দিলে আপনাকে লাশ করে দিতে পারে!’’ বহরমপুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খোদ লোকদেরকে ডিজি গ্রেফতার করতে পারবেন? কিন্তু ডিজি মনে করলে এক চুটকিতে গ্রেফতার করতে পারেন, যদি তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এখনকার ডিজি অনেক বড় বড় তদন্ত সফলতার সঙ্গে করেছেন। কিন্তু দিদির নির্দেশে তিনি পরিচালিত হওয়ার পরে সারদা-কাণ্ড লোকে আর জানতে পারে না। শাহজাহান-কাণ্ডও কতটা লোকজন জানবে, আমার জানা নেই। পুরোটা নির্ভর করছে দিদি কী চাইছেন, তার উপরে।’’ অন্য দিকে, মালদহে এ দিন এসএফআইয়ের রাজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি-সভায় বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “তৃণমূলের অনেক নেতা, মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে জেলে। কেউ কেউ আবার তদন্তের আওতায় আছেন। ফলে, এক জন শাহজাহানকে ধরে কিছু লাভ হবে না। কারণ, তৃণমূলে এমন অনেক শাহজাহান আছে!”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের বহরু স্কুল মাঠে এ দিন ২০ হাজার মানুষকে সরকারি সুবিধা বন্টন করেন মুখ্যমন্ত্রী। এখানকার বিখ্যাত ‘জয়নগরের মোয়া’র প্রসঙ্গ টেনে তার প্রচার ও বিক্রি বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী অতিথিদের মোয়া উপহার দিতে বলেন। সেই সূত্রে কেন্দ্রীয় সংস্থার তল্লাশির দিকে ইঙ্গিত করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সোনা-দানা রাখবেন কী! ইঁদুর, চামচিকেরা যে ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আপনার অর্জিত পয়সা সব লুট করে নিয়ে যাবে। ‘সিজার লিস্ট’ও পাবেন না। বগটুইয়ে নিহতদের টাকা, চাকরি দিয়ে দিয়েছি। ঘরবাড়ি থেকে যে জিনিস টাকা পয়সা নিয়ে আসা হয়েছিল, সেগুলি দেওয়া হয়েছে কী?’’ প্রসঙ্গত, আগেও রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে তল্লাশির ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি।
বিজেপির মতোই এ দিন সিপিএমকে আক্রমণের সুর চড়িয়েছেন মমতা। ব্রিগেড ময়দানে সমাবেশের পরে নতুন করে সিপিএম চর্চায় ফিরে আসায় মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদী সিপিএম এখন বড়বড় কথা বলছে! ৩৪ বছর মানুষের মুন্ডু নিয়ে খেলেছে! ধোপা, নাপিত, স্কুল, কলেজ বয়কট করেছে।’’ সিপিএমকে আক্রমণ করে বহু পুরনো লোডশেডিং প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন তিনি। মমতার প্রশ্ন, ‘‘লোডশেডিংয়ের সরকার আর নেই দরকার! সে দিন মানুষ ভুলে যাবে?’’ বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কথা তুলে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘সিপিএম নিয়ে এসেছে। তাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে কী?’’ সেই সঙ্গে সংস্থাগুলি থেকে বাজেয়াপ্ত করা অর্থ আমানতকারীদের ফেরানোর দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো সারদার মালিককে বাতালিক থেকে গ্রেফতার করেছিলাম। ২০০ কোটি টাকা ফিরিয়ে ছিলাম।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘বিজেপি আর তৃণমূল কয়েক দিন ধরে আমাদের বেশি বেশি গাল দিচ্ছে! ওরা দু’দল ভেবেছিল ভাগাভাগির রাজনীতি করে কাটিয়ে দেবে। ব্রিগেডে সমাবেশ দেখার পর থেকে এখন শয়নে-স্বপনে আবার সিপিএম! মানুষের স্বার্থে বামপন্থীরা রাজনীতি করে, ভাগাভাগির পরে তারাই বাধা।, এটা মমতা-শুভেন্দুরা বুঝতে পারছেন।’’
এরই মধ্যে সন্দেশখালির ঘটনা ‘জনবিস্ফোরণ’ বলে মন্তব্য করে কার্যত সমর্থনই জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মধ্যমগ্রামে সোমবার জেলা তৃণমূল কার্যালয়ে এসে শাহজাহান প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা মেজাজ হারিয়েই তিনি বলেছেন, ‘‘এর পরে ইডি-সহ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি তদন্তে এলেই জনবিস্ফোরণ হবে। এখন তো সবে একটা জায়গায় হয়েছে! এর পরে সারা বাংলা জুড়ে জনবিস্ফোরণ হবে। শুধু ইডি বলেই নয়, যে-ই (এজেন্সি) যাবে, সেখানে জনবিস্ফোরণ হবে।’’ হাতা-খুন্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা ও বাহিনীকে প্রতিহত করার যে মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রী আগে করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতাতেই শোভনদেব এমন কথা বলেছেন বলে সরব হয়েছেন সিপিএমের সুজন, প্রদেশ কংগ্রেসের সৌম্য আইচ রায়েরা।
লোকসভা ভোটের মুখে সরকারি মঞ্চই এ দিন হয়ে উঠেছিল গোটা জেলার নির্বাচনী জনসভা। গত ১১-১২ বছরে শাসক তৃণমূল কী করেছে, তার সবিস্তার বর্ণনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বার্ধক্য ভাতার টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না। তবে আমরা তা দেব। ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ ও ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরে যাঁরা নাম লিখিয়েছেন, তাঁদের ভাতার ব্যাপারে কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাব।’’ প্রসঙ্গত, এই আবেদন করেও বার্ধক্য ভাতা না পাওয়ার সমস্যা সামনে এনে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে দলীয় স্তরে টাকা দেওয়া শুরু করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।