অমিত শাহ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র
পশ্চিমবঙ্গের ‘পিছিয়ে পড়া’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যাবতীয় অভিযোগকে সোমবারই ‘মিথ্যার আবর্জনা’ আখ্যা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছিলেন, প্রতিটি অভিযোগের জবাব দেবেন তিনি। মঙ্গলবারই সবিস্তার তথ্য দিয়ে অমিত শাহের অভিযোগ খণ্ডন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর বললেন, ‘‘সব উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এ জন্য আমাকে কিন্তু অমিত শাহকে খাওয়াতে হবে। আমি গুজরাতি খাবার খেতে চাই, ধোকলা। আমাকে ধোকলা খাওয়াতে হবে ভাল করে।’’
দু’দিনের সফরে রাজ্যে এসে গত রবিবার শাহ অভিযোগ করেছিলেন, অর্থনীতি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো, আইনশৃঙ্খলা— সব দিক থেকেই রাজ্য পিছিয়ে যাচ্ছে। সেই অভিযোগ নস্যাৎ করে সোমবার মমতা বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল কিছু বলার আগে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা। মঙ্গলবার পাল্টা তথ্য দিয়ে তাঁর দাবি, এ সব তথ্য রাজ্যের নয়, কেন্দ্রের কাছেই নথিভুক্ত রয়েছে।
মমতার দাবি, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দারিদ্র দূরীকরণ, একশো দিনের প্রকল্প, গ্রামীণ আবাসন, গ্রামীণ রাস্তা, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প, কারিগরি শিক্ষা, সংখ্যালঘু বৃত্তি, ই-গভর্ন্যান্স, ই-টেন্ডারে এক নম্বরে রয়েছে এ রাজ্য।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় সংস্থা সায় দিলে পিয়ারলেসে পরীক্ষা রুশ টিকার
আরও পড়ুন: ট্যাব কিনতে টাকা দেবে সরকার
২০১১ সালের তুলনায় এখন রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিএসডিপি) ২.৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর আদায় বেড়েছে ২.৯ গুণ। মূলধনী ব্যয়, পরিকল্পনা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৭.২ এবং ৫.৯ গুণ। সামাজিক খাতের খরচ ৫.৬ গুণ বেড়েছে। কৃষি এবং সংলগ্ন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হয়েছে ৬.১ শতাংশ। পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দও ৩.৯ গুণ বৃদ্ধি হয়েছে। পাশাপাশি, কোভিড-আমপানের জোড়া ধাক্কার মধ্যেও রাজস্ব ঘাটতি কমে হয়েছে ১.৫৭। ২০১১ সালে তা ছিল ৩.৭৫। রাজকোষ ঘাটতিও ৪.২৪ থেকে কমে হয়েছে ২.৯৪।
মুখ্যমন্ত্রীর আরও দাবি, জাতীয় স্তরে জিডিপি যেখানে ৪.১৮, সে জায়গায় বাংলায় তা ৭.২৬। দেশের শিল্প বৃদ্ধি এখন ০.৯২, সে জায়গায় এ রাজ্যে তা ৫.৭৯। ২০১১ থেকে এ পর্যন্ত রাজ্যে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, কর্মসংস্থান হয়েছে ১ কোটি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলবেন, জেনে বলা উচিত। দুঃস্বপ্নের নগরী হিসেবে দেখিয়ে গিয়েছেন। ১১ বছর আগে কোথায় ছিলেন? এখন ঝকঝকে হয়েছে রাজ্য, তাই আসছেন। অর্থনীতি নিয়েও অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। অর্থনীতি আমি তেমন ভাল বুঝি না। উনি বোঝেন তো? আমার কথা শুনে ওঁর কত ব্যথা হবে। মনে যেন আমার কথাটা গাঁথা থাকে।’’
রাজনৈতিক হত্যা, হিংসা নিয়ে রাজ্যকে খোঁচা দিয়েছিলেন শাহ। অরাজকতা চরম সীমায় পৌঁছেছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এ দিন মমতা কেন্দ্রের তথ্য তুলে দাবি করেন, ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যে রাজনৈতিক খুন হয়েছিল ৬৬৩টি। ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তা ১৫৩। ধর্ষণের ঘটনা, মাওবাদী-কেএলও দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানিয়েছেন তিনি।
নিরাপদ শহর হিসেবে কলকাতা যে উঠে এসেছে, সেই দাবি করে শাহকে উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে পাল্টা খোঁচাও দিয়েছেন। মমতার মন্তব্য, ‘‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বড্ড বেশি কথা বলেন। চার দিকে দাঙ্গা, খুন, মারপিট, ধর্ষণ, দলিতদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। হাথরস থেকে হাঁসফাঁস, কোনও কথা নেই। মুখে লিউকোপ্লাস্টার। আর বাংলায় আত্মহত্যা হলেও বলছে রাজনৈতিক খুন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হলেও রাজনৈতিক রং লাগানো হয়।’’
মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যে এখন ২৪টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। আরও ১০টি হবে। শিশু-ও প্রসূতি মহিলার চিকিৎসা পরিকাঠামো পৃথক ভাবে তৈরি করেছে সরকার। তাঁর দাবি, স্বাস্থ্যখাতে রাজ্যের বাজেট ২০১১ সালে ৩৫৮৪ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ২ কোটি টাকা। চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। রোগী-সংখ্যা পিছু চিকিৎসকদের সংখ্যার নিরিখে রাজ্য দেশে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
কোভিড ব্যবস্থাপনাতেও রাজ্য যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, সেই দাবিও এ দিন করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘পুরোপুরি নিখরচায় কোভিড চিকিৎসা হচ্ছে রাজ্যে। অন্য কোনও রাজ্য দেখান। কে সত্য, কে মিথ্যা?’’ এ ছাড়া সড়ক পরিকাঠামোর উন্নয়নে শুরু থেকেই যে রাজ্য প্রাধান্য দিয়েছে, সে কথাও এ দিন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে বিদ্যালয় পরিকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে শাহের খোঁচার জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, রাজ্যে ১০০% স্কুলে শৌচালয়ের সুবিধা রয়েছে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাবেন নাকি, শৌচালয় ব্যবহার করে দেখবেন? স্যানিটাইজ় করে দেব, চিন্তা নেই।’’
শিক্ষাখাতে রাজ্যের বাজেট ৬০০% বৃদ্ধির দাবি করে মমতা জানান, ২০১১ সালে কলেজ এবং উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র রাজ্যে ছিল ১৩৮৩টি, এখন তা ১৯৬০টি। সোমবার মমতার মন্তব্যের উত্তরে বিজেপি বলেছিল, শাহ যা বলার তথ্যের ভিত্তিতেই বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা তথ্যে জবাব দিলে বিতর্কে তারা তৈরি। এ দিন অবশ্য দলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।