(বাঁ দিকে) জগদীপ ধনখড়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সিভি আনন্দ বোস। —নিজস্ব চিত্র।
সম্পর্কের শুরুটা ‘মধুর’ হলেও ক্রমেই তা ‘তিক্ত’ হয়েছে। সংঘাতের আবহে আবারও রাজ্যপাল ও রাজভবনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজভবনে ‘দুর্নীতিদমন সেল’ চালু করা নিয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের প্রতি ‘শ্রদ্ধা’ রেখেই মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, রাজ্য সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এ নিয়ে নিজের ‘অসন্তোষ’ ব্যক্ত করতে গিয়ে বুধবার বোসের পূর্বসূরি জগদীপ ধনখড়ের প্রসঙ্গও টানেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘ধনখড়ের সঙ্গেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু উনি এ রকম করেননি।’’
রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে আসার পরে বোসের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক ভালই ছিল। তবে পরে রাজ্য সরকার তথা শাসকদলের সঙ্গে রাজভবনের টানাপড়েন শুরু হয়। পঞ্চায়েত ভোটের সময় হিংসা ও হানাহানি নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন তো বটেই, সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়ে শাসকদলের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে রাজ্যপালকে। ভোট মিটতেই এ বার রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন বোস। রাজভবনে ‘কন্ট্রোল রুম’ খোলা নিয়ে তাঁকে ‘বিজেপির দালাল’ বলে কটাক্ষ করেছে শাসক তৃণমূল। এ বার সেই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, ‘‘রাজ্যপাল মহাশয় নাকি দুর্নীতির ব্যাপারে স্পেশাল সেল করছেন। এটা কিন্তু রাজভবনের কাজ নয়। রাজ্যপালকে আমরা শ্রদ্ধা করি। যেটা রাজ্য সরকারের অধিকার, সেই অধিকারে উনি কোনও প্রয়োজন ছাড়াই হস্তক্ষেপ করছেন।’’
ঘটনাচক্রে, বুধবার বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের আগে বেলার দিকে রাজ্যপালও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। রাজভবন থেকে আনন্দ বোস জানান, সরাসরি এ বার রাজভবনেই দুর্নীতির অভিযোগ জানানো যাবে। তার জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। রাজ্যপালের কথায়, ‘‘কেউ টাকা চাইলে তার ছবি নিন। আমাকে পাঠিয়ে দিন। মুখ্যমন্ত্রী এই কথাই কোচবিহারে বলেছিলেন। আমি তা চালু করতে চাই। কেউ দুর্নীতি করলে জানান। আমরা তা উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছে দেব।’’ এর পরেই রাজ্যপালের ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য ছিল, ‘‘রাজভবন লক্ষ্মণরেখার মধ্যে থেকে কাজ করছে।’’ এর প্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রী ‘রাজভবনের এক্তিয়ার’ নিয়েই প্রশ্ন তুললেন।
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের এনে বাংলায় বিভিন্ন কমিটি গড়া হচ্ছে। রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মমতা বলেন, ‘‘কেন? বাংলায় লোক নেই? আমি শুনলাম, কেরলের এক জনকে এনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে দিয়েছে।’’ উষ্মা প্রকাশ করতে গিয়ে ধনখড়-জমানার কথাও টানেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘ধনখড় যখন ছিলেন, আমাদের সঙ্গে অনেক বিতর্ক হয়েছে, ঝগড়াও হয়েছে। কিন্তু উনি কিন্তু কখনও এটা করেননি।’’ রাজ্যপালের উদ্দেশে মমতার কটাক্ষ, ‘‘এখন দেখছি, মুখোশের আড়ালে বিজেপি যা বলছে, উনি তা-ই করছেন।’’
ধনখড় রাজ্যপাল থাকাকালীনও উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাত চরমে উঠেছিল। মতান্তর এতটাই তীব্র ছিল যে, রাজ্য সরকার মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করে তোলার লক্ষ্যে বিলের খসড়া পর্যন্ত তৈরি করে। এর পর বোস রাজ্যপাল পদে শপথ নেওয়ার পর সেই সংঘাতে ইতি পড়েছিল। বিধানসভায় শীতকালীন অধিবেশন চলার সময় রাজ্যপাল বোসের প্রশংসা করেছিলেন মমতা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘নতুন রাজ্যপাল ভাল। ভদ্র মানুষ। রাজ্য সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই ভাল যে, আর কোনও সমস্যা হবে। আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’’ শুরুতে সম্পর্কের সমীকরণ ছিলও তেমনটা। রাজ্যপালকে বাংলা শেখানোর জন্য সরস্বতী পুজোর দিন রাজভবনে ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীও গিয়েছিলেন। এর পর শিক্ষামন্ত্রী এবং রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা দেন রাজ্যপালও।
এর পর ক্রমেই সংঘাত বাড়তে থাকে। শিক্ষা দফতরকে না জানিয়েই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ রাজ্যের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আচমকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আচার্য তথা রাজ্যপাল। শিক্ষা দফতরের সঙ্গে আলোচনা না করেই বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নতুন নিয়োগও করেছেন তিনি। এই ‘অতি সক্রিয়তা’ ভাল চোখে দেখেনি নবান্ন। সেই সময় থেকে রাজ্যভবন-নবান্ন সম্পর্কে তিক্ততার শুরু। রাজ্যপাল পদের ‘প্রয়োজনীয়তা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও রাজ্যপাল ও শাসকদলের নেতানেত্রীদের মধ্যে কটাক্ষ ও পাল্টা কটাক্ষ নিয়ে সরগরম হয়েছে রাজ্য-রাজনীতি। ভোটের পর সেই উত্তাপ কিছু থিতিয়েও গিয়েছিল। বিধানসভায় বাদল অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ও করে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই আবার রাজ্যপালকে নিশানা মমতার।
ঘটনাচক্রে, রাজ্যপাল বোসের সঙ্গে ‘দ্বন্দ্বের’ আবহে এই প্রথম বার ধনখড়ের প্রসঙ্গ টানলেন মমতা। প্রশাসনিক মহলের একাংশের বক্তব্য, ধনখড়ের কথা টেনে এনে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে, রাজভবনের কাজে ঠিক কতটা ‘রুষ্ট’ নবান্ন। সম্পর্কও যে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তা-ও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন মমতা।
বকেয়া টাকা না মেটানোর অভিযোগ তুলে কেন্দ্রকেও আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে ১০০ দিনের কাজ থেকে আবাস এবং সড়ক যোজনা— সবের টাকা আটকে রেখেছে। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধর্না কর্মসূচিরও ঘোষণা মমতা। মুখ্যমন্ত্রী আক্রমণ, ‘‘(১০০ দিনের কাজে) ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আটকে গ্রামের মানুষ, মাথায় ঝুড়ি বয়েছেন দিনের পর দিন। ১০০ দিনের প্রকল্প কাজের গ্যারান্টি দেয়। ৩০ দিনের মধ্যে টাকা দিতে বাধ্য। অথচ ৭ হাজার কোটি টাকা দিলই না। ২০২৩-’২৪ সালের বাজেট দেখবেন। সব রাজ্যের জন্য বরাদ্দ করেছে, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশা... শুধু বাংলার খাতায় শূন্য। বিজেপির লোকাল নেতারা বারণ করেছে বলেই টাকা দেওয়া বন্ধ হয়েছে।’’
সাংবাদিক বৈঠকে কিছু ঘোষণাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, রাজ্য সরকার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে দেশে-বিদেশে যা পুরস্কার পেয়েছে, তা সবই এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখা হবে। আলিপুর জেলের সংগ্রহশালা সেই সব পুরস্কার রাখা হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। ছুটির ঘোষণাও করেছেন মমতা। এত দিন সবেবরাত ও করমপুজোয় সেকশনাল ছুটি মিলত। এ বার ওই দু’টি দিনেও সম্পূর্ণ ছুটির ঘোষণা করলেন মমতা।