Mamata Banerjee Abhishek Banerjee

প্রায় ছ’মাস পরে মমতা ও অভিষেক এক মঞ্চে, ‘দূরত্ব’ কমল না বাড়ল? জল্পনায় মশগুল তৃণমূলের অন্দর

কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সির ভূমিকা নিয়ে প্রায় এক সুরে আক্রমণ শানিয়েছেন দু’জনে। কিন্তু সিবিআইয়ের চার্জশিটে নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে অভিষেক নিজে জবাব দিলেও মমতা নির্দিষ্ট ভাবে সেই প্রসঙ্গ তোলেননি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:০৫
Share:

বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: এক্স।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতায় বিধানসভা ভোটে আসনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলেন। পাশাপাশিই বললেন, ‘‘হোয়াটস্‌অ্যাপ গ্রুপে রাজনীতি হয় না। যেতে হবে মানুষের কাছে। চক্রান্ত করে কোনও লাভ নেই। যারা চক্রান্ত করবে, তারা আক্রান্ত হবে। ’’

Advertisement

কিছু পরে বলতে উঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় ফিরবেন। পাশাপাশি বলেছেন, ‘‘অভিষেক সবটা গুছিয়ে বলেছে। আমি তো অত গুছিয়ে বলতে পারি না। আমি আমার মতো করে বলছি।’’

বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরের সভার এই দুই দৃশ্য পাশাপাশি রেখে তৃণমূলের অন্দরে ‘আশাবাদীরা’ বলছেন, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে যে ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছিল আপাতত তা ঘুচেছে। আবার ‘সন্দিগ্ধ এবং পোড়খাওয়া’ নেতারা বলছেন, বক্তৃতায় অভিষেকের কিছু কথাকে সিলমোহর দিয়েছেন বটে, কিন্তু ভোটার তালিকা সংক্রান্ত রাজ্যস্তরের কমিটিতে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে একজন ‘সদস্য’ করেই রেখেছেন সর্বময় নেত্রী মমতা। ৩৫ জনের কমিটির মাথায় রয়েছেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। দু’নম্বর নামটি অভিষেকের। যা দেখে তৃণমূলের অভিজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সংগঠনের সুতো এখনও মমতার হাতেই। ধরলে তিনিই ধরবেন। ছাড়লেও তিনিই ছাড়বেন।

Advertisement

মমতা-অভিষেক শেষ বার একই মঞ্চে ছিলেন গত বছর ২৮ অগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে। তার পর এই ২৭ ফেব্রুয়ারি। নেতাজি ইন্ডোরে ১৭ মিনিট বক্তৃতা করেছেন অভিষেক। শুরুতেই বলেছেন, ‘‘অনেক দিন পরে আপনাদের সঙ্গে দেখা হল। মাঝে উৎসব গিয়েছে। কিছু নেতা-কর্মীর সঙ্গে আমার হোয়াটস্‌অ্যাপ, মেসেজে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে। কিন্তু সবার সঙ্গে দেখা হল অনেক দিন পরে।’’ এই পর্বে সংগঠনের মূল স্রোত থেকে অভিষেকের ‘দূরে সরে থাকা’ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। যদিও অভিষেক বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘দূরে’ থাকলেও তিনি কিছু নেতা-কর্মীর সঙ্গে ‘যোগাযোগে’ ছিলেন। পক্ষান্তরে, মমতা শৃঙ্খলার প্রশ্নে দলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘দলের প্রতীকই শেষ কথা।’’ বলেছেন, ‘‘অনেকে বলছেন, আমি তৃণমূল বুঝি না। জোড়াফুল বুঝি না। আমি অমুক দাদার লোক। ও সব হবে না। প্রতীকটাই আসল!’’ তার পরে হুঁশিয়ারির সুরে বলেছেন, ‘‘আমি কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফেসবুক, টুইটার দেখি।’’

এই কথার মধ্যেও ‘নির্দিষ্ট বার্তা’ দেখছেন তৃণমূলের অনেক প্রবীণ নেতা। কারণ, অভিষেকের ‘অনুগামীরা’ সমাজমাধ্যমে সক্রিয় এবং তাঁরা মাঝেমধ্যেই বিবিধ ‘বার্তা’ সেখানে দিয়ে থাকেন। তবে মঞ্চে মমতা-অভিষেকের পারস্পরিক নৈকট্য নজরে পড়েছে। মমতার ঠিক বাঁ পাশের আসনে বসেছিলেন অভিষেক। তিনি মমতার কিছু আগেই মঞ্চে উঠেছিলেন। সামনের সারিতে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশের আসনে বসেছিলেন অভিষেক। মমতা মঞ্চে ওঠার সময়ে অভিষেক-সহ সকলেই উঠে দাঁড়ান। মমতা গোটা মঞ্চ ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে নমস্কার এবং কুশল বিনিময় করেন। তখনও তিনি অভিষেকের মুখোমুখি হননি। তার পরে দলনেত্রী গিয়ে বসেন নিজের আসনে। পরে অভিষেক বক্তৃতা করে ফেরার পরে দু’জনে পরস্পরের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু ক্ষণ কথা বলেন। যা থেকে দলের ‘আশাবাদী’ অংশ আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।

অভিষেক তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘অনেকে বলছে, আমি নাকি বিজেপিতে চলে যাব। আমি নাকি নতুন দল গড়ছি। আমি বলছি, আমার গলা কেটে ফেললেও ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান বেরোবে।’’ সভায় অভিষেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন তিনি তাঁর কেন্দ্রে ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ডায়মন্ড হারবারের মানুষ আমায় ৭ লক্ষ ১০ হাজার ভোটে জিতিয়েছিলেন। তার পরে তিন মাস আমি ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। সারা ক্ষণ ভেবেছি, কী ভাবে এই ঋণ শোধ করব! তার পর সেবাশ্রয় নিয়ে পৌঁছেছি মানুষের কাছে।’’

কেন এমন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হল? ‘সরে থাকার’ পর্বে অভিষেক নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচিতে। তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন সাংসদ। অভিষেকের দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বুধবার পরিষেবাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা আট লক্ষ ছাপিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দলের মধ্যে এই আলোচনাও রয়েছে যে, অভিষেক কি ‘সমান্তরাল’ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে বার্তা দিতে চাইছেন? ঘটনাচক্রে, যে স্বাস্থ্য দফতর রয়েছে মমতার হাতে। কিন্তু বৃহস্পতিবার মমতার উপস্থিতিতেই অভিষেক বুঝিয়েছেন, তিনি কোনও ‘সমান্তরাল মডেল’ তৈরি করার অভিপ্রায় নিয়ে ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি করছেন না।

দ্বিতীয়ত, আইপ্যাককে দলের কাজে ব্যবহার করা নিয়ে মমতার বার্তা। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আইপ্যাকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করে অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতর। সম্প্রতি মমতা পরিষদীয় দলের বৈঠকে ‘প্যাক-ফ্যাক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। যা থেকে তৃণমূলে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, আইপ্যাকের নাম না করে ওই বিশেষণ মমতার সঙ্গে অভিষেকের সাম্প্রতিক দূরত্বপ্রসূত। সেই সূত্র ধরেই মদন মিত্র, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা আইপ্যাক সম্পর্কে ‘তোলাবাজি, অসততা’র অভিযোগ করেছিলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু মমতা বৃহস্পতিবার দলকে বার্তা দিয়েছেন যে, আইপ্যাক সম্পর্কে কোনও ‘উল্টোপাল্টা’ মন্তব্য করা যাবে না। সম্প্রতি নবান্নে মমতার সঙ্গে আইপ্যাকের বর্তমান কর্ণধার প্রতীক জৈনের বৈঠক হয়েছে। ফলে ওই পেশাদার সংস্থার ভূমিকা নিয়ে নেত্রীর ‘অবস্থান’ বদলেছে বলেই সূত্রের খবর। মমতা-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, বিধানসভা ভোটে আইপ্যাককে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী। দলের একাংশে আইপ্যাকের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও তিনি মনে করছেন, অতীতেত তারা যে ভাবে সরকার এবং দলের সঙ্গে কাজ করেছে, তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। অনেকের মতে, অভিষেকের সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনার পরেই মমতা আইপ্যাক সম্পর্কে ‘নরম’ অবস্থান নিয়েছেন। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এই খবরের সত্যতা কেউই স্বীকার করেননি।

প্রসঙ্গত, ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ করার যে নির্দেশ দলনেত্রী মমতা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তিন দিন অন্তর অন্তর তাদের রিপোর্ট পাঠাতে হবে তৃণমূল ভবনে। ৩৫ জনের কমিটির চার জন করে রোজ তৃণমূল ভবনে বসবেন। দলের অনেকের বক্তব্য, ওই নির্দেশ মারফত মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল চলবে তৃণমূল ভবন থেকেই। অন্য কোনও ঠিকানা (ক্যামাক স্ট্রিট) থেকে নয়।

আবার সিবিআই, ইডি-সহ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ‘ভূমিকা’ নিয়ে প্রায় একই সুরে আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা-অভিষেক। কিন্তু সিবিআইয়ের চার্জশিটে তাঁর নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে অভিষেক জবাব দিলেও মমতা নির্দিষ্ট ভাবে সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘ইলেকশন এলেই তৃণমূলকে চোর বলে! এজেন্সির দৌরাত্ম্য বাড়ে, গ্রেফতার বাড়ে। কত লোককে তো গ্রেফতার করলে! কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারোনি।’’

অভিষেক এবং মমতার বক্তৃতার মধ্যবর্তী সময়ে চার সাংসদ ইউসুফ পাঠান, সাগরিকা ঘোষ, কীর্তি আজাদ এবং শতাব্দী রায় মিনিট দুয়েক করে বক্তৃতা করেন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পরে কেন তাঁরা বললেন, তা নিয়েও দলের মধ্যে জল্পনা রয়েছে। কারণ, রেওয়াজ বলছে, এই ধরনের মহা সমাবেশে মমতা শেষ বক্তা হন। সাধারণত তাঁর আগের বক্তা থাকেন অভিষেক। যা থেকে ‘মমতা নেত্রী, অভিষেক সেনাপতি’ বাক্যবন্ধের উৎপত্তি। কিন্তু বৃহস্পতিবার তা হয়নি। দৃশ্য দুই: মঞ্চে নিজের আসনে বসার পরে মমতাকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানান ফিরহাদ হাকিম। যেটি মমতা তুলে দেন অভিষেকের হাতে। আর অভিষেককে ফুলের তোড়া দেন অরূপ বিশ্বাস। তৃণমূলের ভিতরে সকলে জানেন অভিষেক-ফিরহাদের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা। এ-ও জানেন যে, অভিষেক-অরূপ সম্পর্কে খানিকটা ‘জলচল’ রয়েছে। দৃশ্য তিন: সভার সভাপতি ছিলেন সুব্রত বক্সী। রেওয়াজ অনুযায়ী সভাপতিই প্রথম বলেন। তার পরে তিনিই ডেকে নেন পরবর্তী বক্তাদের। বৃহস্পতিবার বক্সী অভিষেক বলবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু অভিষেককে বলতে আহ্বান করলেন অরূপ। আবার ইউসুফ, সাগরিকা, কীর্তি, শতাব্দী থেকে মমতা— সকলের নাম ঘোষণা করলেন বক্সীই।

টুকরো টুকরো ছবি। ছোট ছোট বাক্যে ‘বার্তা’। তৃণমূল তো জল্পনায় মশগুল থাকবেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement