ঝুলি থেকে হঠাৎ চার নতুন জেলা

কোনও প্রস্তুতি নেই। প্রশাসনে নির্দিষ্ট করে তেমন আলোচনাও হয়নি। তবু মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই পশ্চিমবঙ্গে আরও অন্তত চারটি জেলা হতে চলেছে!

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

কোনও প্রস্তুতি নেই। প্রশাসনে নির্দিষ্ট করে তেমন আলোচনাও হয়নি। তবু মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই পশ্চিমবঙ্গে আরও অন্তত চারটি জেলা হতে চলেছে!

Advertisement

শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে এক সরকারি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ‘‘সুন্দরবন, বসিরহাট, ঝাড়গ্রাম ও আসানসোল নতুন জেলা হবে। এর মধ্যে আট-দশ মাসের মধ্যে পরবর্তী নতুন জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে সুন্দরবন।’’

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক, সুন্দরবনের মতো উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটও আলাদা জেলার মর্যাদা পাবে। বর্ধমান জেলা ভাগ হবে দু’ভাগে— শিল্প ও গ্রামীণ। নবান্ন সূত্রের খবর, আসানসোল-রানিগঞ্জের মতো শিল্পাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠবে বর্ধমান শিল্প-জেলা। বাকি কৃষিপ্রধান এলাকা থাকবে বর্ধমান গ্রামীণের আওতায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র পুলিশ জেলা হিসেবে রয়েছে। এ বার তাকেই পূর্ণাঙ্গ জেলার চেহারা দিতে চায় রাজ্য।

Advertisement

জেলা ভাগের এ হেন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সরকারের ব্যাখ্যা: জেলার আয়তন যত ছোট হবে, প্রশাসন তত বেশি গতিশীল হবে। উপরন্তু উন্নয়ন ও পরিষেবামূলক কাজে গতি আনতে ছোট জেলার বিকল্প নেই। মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন বলেছেন, গোসাবা-নামখানা-হিঙ্গলগঞ্জ-সন্দেশখালির মতো সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষে সব সময় বারাসত উত্তর ২৪ পরগনার সদর) বা আলিপুরের (দক্ষিণ ২৪ পরগনার সদর) সরকারি অফিসে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যয়সাপেক্ষও বটে। মমতার আশা, সুন্দরবন আলাদা জেলা হলে সে সমস্যা মিটবে। ‘‘গত চৌত্রিশ বছরে কোনও উন্নয়ন হয়নি। পৃথক জেলা হলে এখানে উন্নয়ন আরও বেশি হবে,’’ মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর।

বস্তুত এই ঘোষণার মধ্যে অনেকে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির সুপারিশের ছায়া দেখছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ওই কমিটি জেলা ভাগ সংক্রান্ত যত সুপারিশ করেছিল, বাম সরকার তার প্রায় কিছুই কার্যকর করেনি। মমতার আমলে গত বছর জলপাইগুড়ি জেলা ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন জেলা (২০তম) আলিপুরদুয়ার। এ দিনের ঘোষণা কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গে জেলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৪।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল— পূর্ণাঙ্গ জেলা হতে গেলে যেমন প্রশাসনিক পরিকাঠামো তৈরি থাকা দরকার, মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ওই চার জেলায় তা আছে কি? নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে একেবারেই নেই। তবে বছরখানেকের মধ্যে সবটাই তৈরি হয়ে যাবে বলে ওঁদের দাবি। যদিও বাস্তবের নিরিখে দেখলে এই দাবির কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয় থেকে যায়।

কী রকম?

বাস্তব বলছে, বছর দেড়েক আগে (২০১৪-র ২৫ জুন) আলিপুরদুয়ার জেলা তৈরি হলেও সেখানে এখনও পরিকাঠামোর অভাবে প্রশাসনিক কাজকর্ম কার্যত কিছুই হচ্ছে না। ‘‘উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই নতুন জেলা তৈরি পরিণাম কী, তার হাতে গরম উদাহরণ আলিপুরদুয়ার,’’ পর্যবেক্ষণ নবান্নের এক পদস্থ আধিকারিকের। যাঁর আক্ষেপ, ‘‘এতে শিক্ষা না-নিয়ে ফের চারটি জেলার ঘোষণা! এতে প্রশাসন ও মানুষের বিভ্রাটই শুধু বাড়বে।’’


সবিস্তারে পড়তে ক্লিক করুন...

প্রশাসনের খবর, আলিপুরদুয়ার জেলা গঠনের সময় অব্যবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এসপি-এএসপি’কে কার্যত একই ঘরে বসে কাজ করতে হতো। এসডিও, এসডিপিও-রা প্রায় ‘উদ্বাস্তু’ হয়ে গিয়েছিলেন। এখন আলিপুরদুয়ারে ডিএম-এসপি’র আলাদা অফিস হয়েছে বটে, তবে আদালত বা শিক্ষা দফতরের অফিসের হাল সেই মহকুমা স্তরেই আটকে রয়েছে। শিক্ষা দফতরে শুধু এক জন ডিআই নিযুক্ত হয়েছেন। মাইনে ও অন্যান্য টাকার জন্য জলপাইগুড়িই ভরসা। মামলা-মোকদ্দমার জন্যও বাসিন্দাদের একশো কিলোমিটার উজিয়ে জলপাইগুড়ি ছুটতে হচ্ছে। আলিপুরদুয়ার চেম্বার অব কর্মাসের সাধারণ সম্পাদক প্রসেনজিৎ দে জানান, জেলায় শিল্পকেন্দ্রে এক অফিসার বসলেও পূর্ণাঙ্গ শিল্প দফতর নেই, ফলে শিল্পের কাজে গতি আসেনি। নবান্ন সূত্রের ইঙ্গিত, আলিপুরদুয়ার প্রশাসনিক ভবন তৈরি করতে আরও দু’বছর লাগবে। তৃণমূলের আলিপুরদুয়ার জেলার সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর জবাব, ‘‘ধীরে ধীরে সব হচ্ছে। কিছুটা
সময় লাগছে।’’

নবান্ন সূত্রেই অবশ্য জানা গিয়েছে, ২০০২-এ তমলুককে সদর ঘোষণা করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়েছিল। ১৩ বছর পরেও সেখানে প্রশাসনিক ভবন গড়ে তোলা যায়নি। ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে মাত্র। চোখের সামনে এ সব দৃষ্টান্ত জ্বলজ্বল করা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণায় প্রশাসনের বড় অংশ বিভ্রান্ত, শঙ্কিতও। নবান্নের একাংশের বক্তব্য: জেলা ভাগ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মাঝে-মধ্যে সাধারণ আলোচনা করেন। কিন্তু সেটা সত্যিই করতে গেলে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিস্তারিত কথা-বার্তা হওয়া দরকার। কিছু প্রক্রিয়াও জরুরি। ‘‘একটা নতুন থানা করতে গেলেও কিছু প্রশাসনিক প্রকরণ-পদ্ধতি মানতে হয়। এ জন্য সময় লাগে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার আগে এ সব তো কিছুই হয়নি!’’ বিস্মিত মন্তব্য এক আধিকারিকের। কর্মিবর্গ দফতরের খবর, মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি নতুন জেলা তৈরির পরিকাঠামোগত বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখবে। জেলার মানচিত্র, থানা, ব্লক, আদালত, হাসপাতাল ভাগাভাগির পাশাপাশি জনসংখ্যা অনুযায়ী সম্পদও ভাগ হওয়ার কথা। এই সব কাজের জন্য অন্তত এক বছরের প্রস্তুতি দরকার। সেই সঙ্গে পরিকাঠামো গড়তে চাই কয়েকশো কোটি টাকা।

এমতাবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেও আগামী আট-দশ মাসের মধ্যে চারটি নতুন জেলা গঠন এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন কর্মিবর্গের কর্তারা। আর বিরোধী রাজনীতিকদের মতে, ভোটের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন স্রেফ চমক দিয়েছেন। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বা বিজেপির শমীক ভট্টাচার্যদের অভিযোগ, ‘‘জেলা ভাগের সিদ্ধান্তের আগে সর্বদল বৈঠক করে মতামত নেওয়া উচিত। সে সব কিছুই হয়নি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement