ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের শীর্ষ মহলকে ফরমান দিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পদ খোয়ানো অফিসারদের শপথের আগেই আগের দায়িত্বে ফিরিয়ে দিতে হবে।
যেমন কথা, তেমন কাজ। কার্যত সে দিনই বদলি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল নবান্ন। দিন চারেক আগে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের চেয়ার থেকে সৌমেন মিত্রকে সরিয়ে রাজীব কুমারকে পুনর্বহাল করা হয়েছে। আর বুধবার অফিসারদের যে বদলির তালিকা নবান্ন প্রকাশ করল, তাতে আইএএস, আইপিএস মিলিয়ে মোট পাঁচ জনকে ‘কম্পালসরি ওয়েটিং’-এ (পদ নেই, কাজও নেই) পাঠিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন! আমলাদের একাংশের দাবি, এমন কাণ্ড এ রাজ্যে আগে কখনও হয়নি।
কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে যেতে হচ্ছে যে চার আইপিএস’কে, তাঁরা হলেন— কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে, ডিসি (এসএসডি) সন্তোষ পাণ্ডে, ডিসি (সাউথ-ইস্ট) সুমনজিৎ রায় ও দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান। আর কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে পাঠানো এক মাত্র আইএএস অফিসারটি হলেন স্মিতা পাণ্ডে, যাঁকে কিনা নির্বাচন কমিশন কলকাতায় ভোটের আগে দক্ষিণ কলকাতার ‘ডিস্ট্রিক্ট ইলেকটোরাল অফিসার’ (ডিইও) হিসেবে নিয়োগ করেছিল। আইপিএস মহলের একাংশের অভিযোগ, যে সব এলাকায় শাসকদল ভোটে তুলনায় খারাপ ফল করেছে, সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হল। ‘‘ওঁরা রাজনীতির শিকার।’’— মন্তব্য একাধিক আইপিএসের। আইএএস স্মিতার ক্ষেত্রেও শাসক দল একই মনোভাব নিয়েছে বলে অভিযোগ।
কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে পাঠানো চার আইপিএসের মধ্যে ধ্রুবজ্যোতি দে ও সন্তোষ পাণ্ডে ভোটের আগে থেকেই যথাক্রমে ডিসি (ইএসডি) এবং ডিসি (এসএসডি)-র দায়িত্বে ছিলেন। বাকি দু’জন কমিশনের নির্দেশে নতুন দায়িত্বে গিয়েছিলেন। রশিদ মুনির খান কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ ওয়েস্ট) থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরে এসপি হয়ে যান। সুমনজিৎকে ডিসি (এসসটিএফ) থেকে ডিসি (সাউথ-ইস্ট)-এর দায়িত্বে পাঠানো হয়। ভোটে রাজ্যের বিদায়ী পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী-সহ দক্ষিণ দিনাজপুরের বেশ ক’জন তৃণমূল প্রার্থী হেরে গিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বালুরঘাটের তৃণমূল সাংসদ অর্পিতা ঘোষও রশিদ মুনির সম্পর্কে দলীয় নেতৃত্বকে নালিশ করেছিলেন। অন্য দিকে শাসকদলের প্রার্থী না-হারলেও সুমনজিতের এলাকা, অর্থাৎ কসবার বেশ কিছু ওয়ার্ডে জোটপ্রার্থীর চেয়ে কম ভোট পেয়েছে তৃণমূল। প্রশাসনের একাংশের পর্যবেক্ষণ, সেই কারণেই ওই দুই আইপিএসের ঘাড়ে কম্পালসরি ওয়েটিংয়ের কোপ।
এবং একই কারণে ধ্রুবজ্যোতি ও সন্তোষকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে বলে লালবাজারের অন্দরে আক্ষেপ প্রকট। অনেকে বলছেন, ভোটের ফল প্রকাশের পরেই যাদবপুর নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ইঙ্গিত ছিল, ‘অন্তর্ঘাত’ ও ‘পুলিশের একাংশের কার্যকলাপে’ সেখানে তৃণমূল হেরেছে। আইপিএসদের একাংশ বলছেন, সন্তোষের সাউথ সুবার্বন এলাকাতেই পড়েছে গোটা যাদবপুর, যেখানে তৃণমূল প্রার্থী মণীশ গুপ্ত হেরে গিয়েছেন। আর ধ্রুবজ্যোতির বিরুদ্ধে ‘অতি সক্রিয়তা’র নালিশ জমা পড়েছিল তৃণমূল নেতৃত্বেরকাছে।
ফল হাতে-নাতে পেয়ে গিয়েছেন ওঁরা। ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে। তবে তার পিছনেও রাজনীতির অঙ্ক আছে বলে প্রশাসনে গুঞ্জন। কী রকম?
এই মহলের বক্তব্য: ভোটের মুখে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে নদিয়ার এসপি ভাস্কর মুখোপাধ্যায়কে সরিয়ে সিসরাম ঝাঝারিয়াকে এনে বসিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। দেখা যায়, শাসকদলের হিসেব উল্টে তৃণমূল ওখানে ভাল ফল করেছে। তাই সিসরামকে না-সরিয়ে ভাস্করকে কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) করা হয়েছে। একই ভাবে মিরাজ খালিদ ভোটের আগে কলকাতার ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট)-র দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বেহালার দু’টি কেন্দ্রই তাঁর এলাকায়। অনেকের দাবি, সেখানে তৃণমূল জেতায় খালিদকে একই পদে বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ওএসডি (মাওবাদী দমন) পদ থেকে কমিশন যাঁকে সরিয়েছিল, সেই মমতা-ঘনিষ্ঠ ভারতী ঘোষকে তাঁর পুরনো পদ পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।