এ কী চেহারা করেছেন মশাই!
ন’মাস পরে বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় আলিপুর জেলে পা রাখেন মদন মিত্র। শুক্রবার তাঁকে দেখে এমনই প্রতিক্রিয়া ছিল দুই বন্দির। জেলের এক অফিসারের কাছে তাঁরা বলেও ফেলেন সে কথা— ‘‘ভুগে ভুগে মদনবাবুর চেহারাটা একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে। ওষুধের ঘোরে তো কিছু খেতেই চাইছেন না। সারা দিন শুয়ে থাকেন।’’
সাধারণত, নতুন আসা বন্দিদের রাখা হয় জেলের ‘আমদানি’ ওয়ার্ডে। কিন্তু তিনি মদন মিত্র। শাসক দলের প্রথম সারির নেতা। তাই মন্ত্রী না থাকলেও কার্যত মন্ত্রীর মর্যাদা পেতে অসুবিধা হয়নি। জেলের চিকিৎসক পরীক্ষা করার পরে তাঁকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আলিপুর জেলের ছ’নম্বর ওয়ার্ডে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অসুস্থ হয়ে এসএসকেএম-এ যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই ছ’নম্বর ওয়ার্ডের দোতলাতেই থাকতেন মদন। জেলের চোখে এটা ‘মন্দির’ ওয়ার্ড নামেই পরিচিত।
এই ওয়ার্ডেই তাঁকে দেখে রীতিমতো চমকে যান বন্দিরা। ফেব্রুয়ারি মাসে মদন যখন জেল থেকে এসএসকেএম-এ গিয়েছিলেন, তখন এই বন্দিরাই ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রীর প্রতিবেশী। তাঁরা ওখানেই রয়েছেন। ন’মাস পরে মদনকে দেখে তাঁদের অনেকেই অফিসারদের কাছে বলেছেন, ‘আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে’। এক বন্দি বলেছেন, ‘‘আগে তো উনি বেশ খাওয়া-দাওয়া করতেন। এ বার হল কী! দুপুরে দু’টো রুটি আর একটু সব্জি। মাছও তো খেলেন না দেখলাম। জানতে চাইলে বললেন, মাছ-মাংসের গন্ধ আর সহ্য করতে পারি না। এখন নিরামিষ খাবারই খাই।’’
এমনিতে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠাই প্রাক্তন মন্ত্রীর অভ্যাস। এ দিনও তার অন্যথা হয়নি। বেলা দশটারও পরে ঘুম থেকে ওঠেন। খাওয়া বলতে দুপুরে আর রাতে রুটি-সব্জি। মাঝখানে এক কাপ চা। জেল সূত্রের খবর, সারা দিন ওয়ার্ড থেকে কার্যত বের হননি তিনি। তবে মাঝে-মধ্যে সহ-বন্দিদের কাছে নিজের নাতি মহারূপকে নিয়ে গল্প করেছেন। বিকেলে জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন স্ত্রী, বড় ছেলে ও তাঁর স্ত্রী এবং নাতি। জেলের অফিসারেরা জানান, নাতিকে দেখার পর থেকেই মদনবাবুর গুমোট ভাবটা কিছুটা কেটেছে। বাড়ির লোক ফিরে যেতে ওয়ার্ডের পথে বাগানে একটু হাঁটাহাঁটিও করেন। পরনে ছিল সাদা পাজামা আর গেরুয়া রঙের ফতুয়া।
মাত্র দু’দিন আগেই তাঁর মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। তবু এ দিন সকালে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আলিপুর আদালতের যে নথি এসে পৌঁছেছে সেখানে মদন মিত্রকে ‘ডিভিশন ওয়ান’ বন্দির তকমা দেওয়া হয়েছে। এ রাজ্যে সংশোধনাগার আইন অনুযায়ী, সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন বন্দি, যাঁরা সামাজিক পরিচয়, শিক্ষাগত কিংবা আর্থিক কারণে জেলের আম-বন্দির থেকে ভাল থাকতে অভ্যস্ত, তাঁদের সাধারণত প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেলে ওই বন্দি বেশ কিছু অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধে ভোগ করেন। তার মধ্যে ভাল খাওয়াদাওয়া, সেলের মধ্যে টেবিল চেয়ার, খবরের কাগজ, লেখার সরঞ্জাম, টুথব্রাশ, পেস্ট, সাবান পাওয়ার অধিকার অন্যতম। কারা দফতর নিজে থেকে কোনও বন্দিকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিতে পারে না। আদালতের নির্দেশেই তা দেওয়া হয়। যেমন হয়েছে মদনের ক্ষেত্রে।
তাই মন্ত্রী না হলেও প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা পেয়ে প্রায় মন্ত্রীর মতোই সুবিধেই পাচ্ছেন তিনি। তাঁকে ‘আলাদা’ বোঝাতে ওয়ার্ডের মধ্যেই অস্থায়ী ভাবে ‘সেল’ তৈরি করা হয়েছে। তাঁর জন্য একটি টেলিভিশনেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মদন মিত্রের চলাফেরায় কোনও সীমারেখা টানা হয়নি।
তবে এ সবে যেন মন নেই মদনের। বরং, বেশির ভাগ সময় গুম মেরে থেকেছেন। জেলের এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘ক’দিন প্রচুর টেনশন এবং ধকল গিয়েছে। সে জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত। আশা করি, দু’এক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন।’’ জেলের খবর, প্রাক্তন মন্ত্রীর শরীর ঠিক আছে। কাল রাতে এবং আজ সকালে জেলের চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করেছেন। শাসক দলের দাপুটে নেতাকে এসএসকেএম হাসপাতালের লিখে দেওয়া ওষুধই খাওয়ানো হয়েছে।