কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে মদন মিত্রের আইনজীবী কপিল সিব্বল।
শেক্সপিয়র অনেক কাল আগেই তুলে গিয়েছেন প্রশ্নটা। ‘টু বি অর নট টু বি’? সেই অমোঘ প্রশ্নের সামনেই এখন নিজেকে এবং তাঁর দলকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মদনগোপাল মিত্র!
সারদা-কাণ্ডে রাজ্যের পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বিরোধীরা সরব। তাঁদের প্রশ্ন, জেলবন্দি মদনকে মন্ত্রিত্বে রেখে দেওয়া হবে কেন? এত দিন তাঁদের প্রশ্নে মাথা ঘামাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই জেলে থেকেই মদন মন্ত্রী আছেন। দফতরবিহীন হয়েও নয়, আক্ষরিক অর্থেই ‘পূর্ণমন্ত্রী’ হয়ে আছেন। সেই মদনই বৃহস্পতিবার জামিন পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় আদালতে বার্তা দিয়েছেন মন্ত্রিত্ব ছাড়ার। তাঁর আইনজীবী কপিল সিব্বল সওয়াল করতে গিয়ে বলেছেন, মন্ত্রিত্বই যদি তাঁর মক্কেলের জামিনের পথে বাধা হয়, তা হলে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।
আদালতে এর আগে এক বার মদনের অন্য আইনজীবী খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নাম তুলে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিলেন। এ বারও ফের শাসক দলের অন্দরে চর্চায় ফিরেছে মদনের আইনজীবীর সওয়াল। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি দলীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনিই মদনের আইনজীবীর গলায় শোনা গেল? দলের এক শীর্ষ নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘এই রকম কোনও সিদ্ধান্তই হয়নি! মদন নিজের জন্য যেটা ভাল মনে করছে, সেটাই বলে দিচ্ছে! এই সব করেই মামলাটা দিন দিন জটিল হয়ে গেল!’’
মদনের আইনজীবীর সওয়াল উভয় সঙ্কটে ফেলেছে শাসক দলকে। এগোলেও বিপদ। না-এগোলেও বিপদ! পরিস্থিতির বিচারে মদনকে এখন মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হলে প্রশ্ন উঠবে— এত দিন অপেক্ষা করা হচ্ছিল কেন? আবার না-সরালে বিরোধীরা আরও জোর গলায় বলবেন, সরকারের কোনও নৈতিকতার বোধই নেই! পরিস্থিতির প্যাঁচ আন্দাজ করেই তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, ‘‘হয় মাসের পর মাস জেলে থেকে মদন হতাশা থেকে এ সব বলাচ্ছে। নয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন সব বিষয় তোলাচ্ছে, যেগুলো চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে!’’
বিরোধীরা অবশ্য মদনের মন্ত্রিত্ব ছাড়ার ইচ্ছাকেও বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, ‘‘আদালতে বলা হয়েছে, জামিন পেলে উনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে রাজি। কিন্তু এটা তো কোনও শর্তের ব্যাপারই নয়! ওঁকে কেন মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত করা হবে না? আসলে মুখ্যমন্ত্রীর ভয় আছে। মন্ত্রিত্ব থেকে সরালে মদনও যদি ওঁদের ওই সাংসদের (কুণাল ঘোষ) মতো মুখ খুলতে শুরু করেন!’’ প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলছেন, ‘‘আদালতকে বোকা বানানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল! মন্ত্রী থাকা বা না-থাকা কোনও ব্যাপার নয়। আসল কথা হল, মুখ্যমন্ত্রীর যাঁরা কাছের লোক, তাঁদের যে কোনও মূল্যে আড়াল করবে সরকার।’’
দিল্লি থেকে দুঁদে আইনজীবী আনানোর ব্যাপারে মদনের ইচ্ছায় সায় দিয়ে তৃণমূলের অন্য বিপত্তিও বেড়েছে। জামিন-মামলায় সওয়াল করার জন্য বিপুল দক্ষিণা দিয়ে সিব্বলকে উড়িয়ে এনেছিলেন কামারহাটির বিধায়ক। তাতে সবুজ সঙ্কেত ছিল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরও। কারণ, তিনিও বিলক্ষণ জানেন, সৃঞ্জয় বসু, দেবব্রত সরকার, রজত মজুমদাররা জামিন পেলেও প্রায় আট মাস বন্দি থেকে মদন এখন অভিমানী। এর উপরে জাঁদরেল উকিল আনতে বাধা দিলে ক্ষোভ বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যখন সিব্বলের সওয়ালেও চিড়ে ভেজেনি, বিপদ টের পাচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘পেশার খাতিরে সিব্বল তো পাওনা বুঝে নিয়ে চলে গেলেন। মদন বেরোতে পারল না! উল্টে বিরোধীরা এখন পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছে, এমন আইনজীবীর ফি, যাতায়াত, হোটেলে রাখার বিপুল খরচ কোথা থেকে এল?’’
মদন, জামিন ও মন্ত্রিত্ব নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এ দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খোলেননি। তবে ঘরোয়া আলোচনায় দলের অনেকেই মনে করছেন, নিজের মুখ নিজেই পুড়িয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী! দলের এক আইনজীবী নেতার মতে, ‘‘কলকাতায় ফৌজদারি মামলায় দক্ষ আইনজীবী হিসাবে নাম আছে শেখর বসু, মিলন মুখোপাধ্যায়দের। তাঁরা কিছু করতে পারেননি। এ বার সিব্বলও ব্যর্থ হলেন। একের পর এক দরজা তো বন্ধ হয়ে আসছে!’’ শাসক দলেরই আর এক নেতার ক্ষোভ, ‘‘ধমকে-চমকে যে সব কাজ হয় না, মদন বা তাঁর অনুগামীরা বোঝেননি। আর তার মাসুল আজ মদনকে দিতে হচ্ছে!’’ আলিপুর আদালতে শুনানি চলাকালীন মদনের অনুগামীদের বিক্ষোভের দিকেই ইঙ্গিত ওই নেতার। তাঁর ধারণা, ‘‘ওই বিশৃঙ্খলায় এক দিকে সিবিআই এবং অন্য দিকে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বিরক্ত হয়েছেন।’’
দেদার সামাজিকতা, মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সুবাদে মদনের উপরে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের সহানুভূতি আছে অবশ্যই। আর সেই আবেগ থেকেই কর্মীদের একাংশের ধারণা, তাঁদের ‘দাদা’র পাশে দলীয় নেতৃত্ব সে ভাবে দাঁড়াচ্ছেন না। সেই অভিমান থেকেই ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’ শীর্ষক হোর্ডিং পড়ছে রাস্তায়। কিন্তু দলেরই প্রথম সারির নেতারা তাঁদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘দিদি’র হাত মাথার উপরে না থাকলে মদন এ ভাবে মন্ত্রী পদ ধরে রেখে এবং এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে দিনের পর দিন কাটাতে পারতেন?
এত কিছুর পরেও ফিরে আসছে সেই প্রশ্নটাই— অতঃকিম? মদন-ঘনিষ্ঠদের সূত্রে ইঙ্গিত মিলছে, এর পরে জামিনের আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ার প্রস্তুতি। কিন্তু তাতেও এখন আশার আলো দেখছেন না অনেকে। সিব্বলের সওয়াল ব্যর্থ হওয়ার পরে মন্ত্রিসভায় মদনের এক সতীর্থের হতাশ প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওকে মনে হচ্ছে আর ছ়া়ড়বে না! মন্ত্রী থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী!’’
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।