গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নতুন ‘ব্র্যান্ড’ যেন ঠিক পসার জমাতে পারল না পুজোর বাজারে। ছোটখাটো ‘ব্র্যান্ড’ নয়, সারা ভারতে পরিচিত। রাজনীতিতে নতুন বললেও, ঠিক বলা হয় না। বড়জোর বলা যেতে পারে, বাংলায় তার রমরমা কিছুটা নতুন। কিন্তু কলকাতার দুর্গোৎসবে সে রমরমার ছাপ প্রায় পড়লই না। পদ্মফুলের ‘লোগো’ ভারত কাঁপিয়ে দিলেও, কলকাতার বড় বড় মণ্ডপগুলো থেকে ‘ব্র্যান্ড প্রোমোশনের’ ইচ্ছা খুব একটা পূরণ হল না বিজেপির। তাই মাত্র একটা পুজোর উদ্বোধন করেই কলকাতা ছাড়বেন অমিত শাহ।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মঙ্গলবার কলকাতায় আসছেন। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৈঠক এবং সভা করবেন। এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অমিত শাহ কী বলেন, তা জানার অপেক্ষায় গোটা বাংলা। কিন্তু বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা আরও একটা অপেক্ষায় ছিলেন। কলকাতার বেশ কিছু নামী পুজো মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে ফিতে কাটছেন অমিত শাহ— এই দৃশ্য দেখতে চাইছিলেন অনেকেই। কিন্তু সে দৃশ্য অদেখাই থেকে যাচ্ছে এ বছর। সল্টলেকের বিজে ব্লকের পুজো ছাড়া আর কোনও উদ্বোধন অমিত শাহের হাতে যে হচ্ছে না, তা মোটের উপর নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।
এ বারের পুজো নিয়ে বিজেপির পরিকল্পনা কিন্তু এত সীমিত ছিল না। গত কয়েক বছর ধরেই ছোটখাটো বা মাঝারি কিছু পুজোর উদ্বোধন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত দিয়ে হচ্ছিল। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়রাও পুজো উদ্বোধনে ডাক পাচ্ছিলেন। বাংলায় ১৮টি লোকসভা আসনে জেতার পরে সে ডাক আরও বেশি করে আসবে বলে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব আশা করেছিলেন। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবে তাঁদের দল আরও বেশি করে অংশগ্রহণ করুক, এমনটা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘সব সত্যি বলে দিয়েছি’, জানালেন মির্জা, মুখোমুখি জেরায় নিশানায় ছিলেন মুকুলই
প্রস্তুতিও শুরু হয়েছিল সেই মতোই। কলকাতা এবং শহরতলির বেশ কিছু বড় পুজো কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল মুরলীধর সেন লেনের কর্তাদের। কোনও ক্ষেত্রে পুজো কমিটিগুলোর তরফ থেকেই বিজেপির কাছে প্রস্তাব পৌঁছেছিল। কোনও ক্ষেত্রে আবার বিজেপি নেতারাই পুজো কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে খবর। কিন্তু সে তৎপরতা সাফল্যে রূপান্তরিত হল না। কলকাতার বুকে একটাও বড় পুজো কমিটির কর্তৃত্ব বিজেপি নেতাদের হাতে গেল না।
পুজোর কলকাতায় তৃণমূলকে প্রথম ধাক্কাটা বিজেপি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পাড়াতেই। সঙ্ঘশ্রীর পুজোর কর্তৃত্ব প্রায় হাতে নিয়েই ফেলেছিলেন সায়ন্তন বসু। তাঁকে মাথায় বসিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছিল। খুঁটিপুজোর দিনও স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরেই আসরে নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পরিবার। তাঁর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতায় খুঁটিপুজো আটকে যায়। সঙ্ঘশ্রীর কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন করে বৈঠক করেন কার্তিক, নয়া কমিটি গঠিত হয়। তার পরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মালা রায়দের সঙ্গে নিয়ে সঙ্ঘশ্রীর খুঁটিপুজো সারেন তিনি।
মিইয়ে গেল ‘ব্র্যান্ড পদ্ম’, পুজোর ময়দানে তৃণমূলের কাছে গোহারা বিজেপি।—ফাইল চিত্র।
এই ঘটনার পরে কিছুটা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল বিজেপি। আরও কিছু বড় বড় পুজোর কর্তৃত্ব এ বার বিজেপির হাতে থাকছে, কিন্তু নাম পরে প্রকাশ করা হবে— বিজেপির তরফে এই রকমই জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে কলকাতার আর একটা বড় পুজোর কর্তৃত্বও বিজেপি নিজের হাতে রাখতে পারেনি। লাগোয়া সল্টলেকের বিজে ব্লকের পুজো অনেক দিন ধরেই বিজেপির হাতে ছিল। শুধুমাত্র সেটা ধরে রাখতে পারার মধ্যে যে খুব বড় কৃতিত্ব নেই, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন: টালা সেতুতে বাস বন্ধ, চূড়ান্ত দুর্ভোগের শিকার যাত্রীরা, বিকল্প পথ বাছতে কাল বৈঠক নবান্নে
বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করছেন, পরিস্থিতি অতটা খারাপ নয়। সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘আমি নিজে দুটো পুজোর সভাপতি। আরও দুটো পুজো কমিটির সদস্য। কলকাতা, শহরতলি এবং হাওড়া মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০টা পুজোর উদ্বোধন আমাকে করতে হবে। আর দিলীপ ঘোষকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর অনুরোধ এত জায়গা থেকে এসেছে যে, দিলীপদা সব জায়গায় হয়তো সময় দিতে পারবেন না।’’
বিজেপি নেতারা যে দাবিই করুন, বড় পুজোর কর্তৃত্ব হাতে নেওয়ার লড়াইয়ে কিন্তু তৃণমূলকে বিন্দুমাত্র ধাক্কা তাঁরা দিতে পারেননি। চেষ্টা যে হয়েছিল, তা অস্বীকার করার জায়গায় আর বিজেপি নেতারা নেই। চেষ্টা ধাক্কা খেতেই কৌশল বদলানো হয়েছিল। কোন কোন পুজোর উদ্বোধন বিজেপি নেতাদের হাত দিয়ে হবে, তা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তাতেও সম্ভবত সব গোপন থাকেনি। পুজোর কলকাতায় নিজেদের গড় অক্ষুণ্ণ রাখতে তৃণমূলও সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছিল। অবশেষে বিজেপি সূত্রে জানানো হয়েছিল, তৃতীয়ার দিন কলকাতায় এসে ৫টি পুজোর উদ্বোধন করবেন অমিত শাহ। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত অমিত শাহ ১টি পুজোর উদ্বোধন করবেন বলে স্থির হল। সেই পুজো কমিটির মধ্যেই আবার বেশ কয়েক জন বেসুরে গাইতে শুরু করলেন।
সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘আরও বেশ কয়েকটা পুজোর উদ্বোধন অমিতজিকে দিয়ে করানোই যেত। কিন্তু সময় কম। যে দিন অমিতজি কলকাতায় আসছেন, তার পরের দিন গাঁধী জয়ন্তী। তাই ওঁকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে।’’
কিন্তু অমিত শাহ যে পুজোর উদ্বোধন করছেন, সেটা ছাড়া আর কোন বড় পুজোর কর্তৃত্ব হাতে নিতে পেরেছে বিজেপি? সায়ন্তনের দাবি, দমদম এবং বাগবাজারে দু’টি বড় পুজোর উদ্বোধন দিলীপ ঘোষের হাতে হবে। হাওড়া এবং সোনারপুরেও দু’টি বড় পুজোর নিয়ন্ত্রণ বিজেপির হাতে বলে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আগামী কাল অমিত শাহের সভায় বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন সব্যসাচী দত্ত
তৃণমূল স্বাভাবিক কারণেই উল্লসিত। গত লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার দু’টি আসনই তৃণমূল নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু কলকাতা পুর এলাকার ৫০টি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে। আগামী বছর পুর নির্বাচন। তার আগে মহানগরের দুর্গোৎসবের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার লড়াইয়ে যদি বিজেপি বড়সড় সাফল্য পেত, তা হলে তৃণমূলের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হত। কিন্তু তেমনটা হল না।
কেন হল না, তার ব্যাখ্যাও কিন্তু দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। কলকাতার প্রখ্যাত পুজো উদ্যোক্তাদের অন্যতম হলেন প্রবীণ রাজনীতিক তথা রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি যে ভাবে ময়দানে নামতে চেয়েছিল, সেটা সম্ভবত কলকাতার মানুষ মানতে পারেননি। একটা রাজনৈতিক দল বিভিন্ন পুজোর দখল হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এই রকম আমরা আগে কখনও দেখিনি। কেউই দেখেননি। তাই লোকের মানতে অসুবিধা হয়েছে।’’
একডালিয়া এভারগ্রিনের প্রাণপুরুষ সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে পুজোর আয়োজন করে আসছি। আরও অনেকেই করছেন। কিন্তু কেউ কোনও দিন পুজোর সঙ্গে রাজনীতিকে জড়াইনি। পুজোটা আসলে সবার। পাড়ার সবাই তাতে অংশ নেন। বাচ্চারা থাকে, ছাত্ররা থাকে, যুবকরা থাকে, বয়স্করা থাকেন। কে কোন দলের, কে কোন ধর্মের, এ সব কেউ ভাবেনই না।’’ সুব্রত বলেন, ‘‘সিপিএমের আমলেও কখনও দেখিনি যে, পুজোর দখল নিয়ে কোনও টানাপড়েন চলছে। বিজেপি কেন পুজোটাকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানোর কথা ভাবল, বুঝতে পারলাম না।’’
বিজেপি নেতাদের কাছেও কিন্তু সদুত্তর নেই। নির্বাচনে এত বড় সাফল্য, তার পরে রাজ্য নেতৃত্বের তরফে তৎপরতা— তাও কেন পুজোর কলকাতায় সে ভাবে দাগ কাটা গেল না? জবাব এড়িয়েই যাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তবে উত্তর শহরতলি থেকে উঠে আসা এক নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘তৃণমূলের কাউন্সিলর, বিধায়ক, সাংসদ— সবাই মিলে মাঠে নেমেছিলেন কমিটিগুলো হাতে রাখতে। পুলিশ-প্রশাসনকেও ব্যবহার করা হয়েছে সে কাজে। অনেক পুজোর কর্মকর্তাই ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছেন।’’