ঝড়ের আকাশ, রূপালী রেখাও নজর এড়ায় না

এক-একটি পাড়ার বৈশাখী বাতাস পদ্মগন্ধে ম-ম। ইদানীং পুকুরের এ পাড়ে বসে ও পাড়ের পরিচিতকে দেখে হাত নেড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ হেঁকে চলে সম্ভাষণ।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় 

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১১
Share:

প্রতীকী ছবি।

চৈতন্য-প্রেমের নদিয়ায় ধুন্ধুমার বেঁধেছিল গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে। রক্তারক্তি, ছাপ্পা, বোমা, বুথ দখল, খুন।

Advertisement

অতঃপর দুয়ারে মহারণ। দিল্লি দখলের লড়াই। নদিয়ায় রাজনীতির গনগনে আঁচ। রানাঘাট কেন্দ্রের শান্তিপুর হোক বা হাঁসখালি, নবদ্বীপ কিংবা কৃষ্ণগঞ্জ—বাতাসে কান পাতলেই শুধু জোড়া ফুল বনাম এক ফুল। এ লড়াইয়ে হাতের আহ্বান বা কাস্তে-হাতুড়ির ঠুকঠাকও রয়েছে, তবে তারা এলেবেলে।

এক-একটি পাড়ার বৈশাখী বাতাস পদ্মগন্ধে ম-ম। ইদানীং পুকুরের এ পাড়ে বসে ও পাড়ের পরিচিতকে দেখে হাত নেড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ হেঁকে চলে সম্ভাষণ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পদ্মপ্রীতি যেন একটু ঊর্ধ্বমুখী। এলাকার পর এলাকায় থিকথিকে বিজেপির পতাকা আর ফেস্টুন। নিত্য তাদের আয়োজিত ধর্মসভা বা কীর্তনের সঙ্গে আলগোছে চলে ভোটের ব্রেনওয়াশ।

Advertisement

তার পাশেই পর-পর গ্রামে ধুপধুনো জ্বালিয়ে তৃণমূল নেত্রীর ছবিতে সন্ধ্যারতির সংস্কৃতি। দেওয়ালে দেওয়ালে মা-মাটি মানুষের জয়ধ্বনি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ফুলিয়ার মাঠপাড়ার আশি ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা বলেন, ‘‘এ বার পদ্মতে দেব।’’ আবার বাদকুল্লার শি‌ক্ষকের মন্তব্য, ‘‘যত দিন বাঁচব শুধু দিদিকেই জেতাব।’’

নবদ্বীপের বড়াল ঘাটে চায়ের দোকানের প্রবীণ কর্মী ফোকলা দাঁতে হাসেন, ‘‘আমি এ সব ভোট-ফোটের মধ্যে নেই। তবে ভালই জমেছে। নিমাইয়ের লীলাক্ষেত্রে কদম-গাঁদা গেল তল, এখন পদ্ম-ঘাস মাথা তোল!’’ পাশে বসা উৎসাহী তরুণ উপভোগ করছিলেন বাক্যালাপ। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল—‘হাওয়া কোন দিকে?’ রহস্য-রহস্য মুখ করে গলা নামিয়ে উত্তর দিলেন, ‘‘এ বার শুধু চাপা হাওয়া! ঝড় উঠল বলে।’’

চাকদহের সিংহের বাগানে নিজের বাড়ির দোতলায় বসে রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক, পোড় খাওয়া নেতা শঙ্কর সিংহ নিজের ডান পায়ে একটা চাপড় মারলেন। ‘‘রাখুন তো, ও সব ঝড়-ফর। কত দেখলাম। এ ঝড়ও মিলিয়ে যাবে, রানাঘাটের গায়ে লাগবে না।’’ কিন্তু ঝানু নেতার আত্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন হাঁসখালির গোবিন্দপুর গ্রামের শ্যামলা তরুণী। ভ্যানরিক্সার উপর বসানো সাউন্ড বক্সে তখন বাজছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার রেকর্ড। আঙুল দিয়ে সে দিকে তাকিয়ে গনগনে মুখে বললেন, ‘‘তৃণমূলের কোনও নেতা এ বার বাড়ি বাড়ি ভোট চাইতে আসছে না হাঁসখালিতে। আসবে কোন মুখে! আমাদের কাউকে পঞ্চায়েত ভোটে ভোট দিতে দেয়নি। নিজেদের ক্ষমতায় আস্থা থাকলে মানুষের ভোটকে ভয় পাবে কেন? এখন ভোট চাইতে এলেই তো সেই প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই রেকর্ড বাজাচ্ছে। শুধু এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনীটা থাকুক। বাকিটা বুঝে নেব।’’

এমনই এক আবহে এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা মাস্টারস্ট্রোক—রূপালী বিশ্বাস।

কৃষ্ণগঞ্জের দাপুটে তৃণমূল বিধায়ক, সংগঠক, দলের মতুয়া-মুখ সত্যজিৎ বিশ্বাস খুন হন গত সরস্বতী পুজোর আগের রাতে। পুরনো-অভিজ্ঞ নেতাদের বদলে সত্যজিতের স্ত্রী রূপালীকেই প্রার্থী নির্বাচন করেন মমতা। মনোনয়ন জমা দেওয়ার কয়েক দিন আগে পঁচিশ পূর্ণ হয়েছে তাঁর। তিনি মহিলা, তাঁর অতীত নিষ্কলুষ, রাজনৈতিক শত্রুহীন, অল্পবয়সী বিধবা, সঙ্গী মাত্র দেড় বছরের শিশুপুত্র—সব মিলিয়ে সহানুভূতি ভোট পাওয়ার আদর্শ মিশেল।

তাঁকে সর্বক্ষণ আগলে রেখেছেন এবং পরামর্শ দিচ্ছেন গৌরীশঙ্কর দত্ত, রিক্তা কুণ্ডু, রত্না ঘোষ করের মতো দলের অভিজ্ঞ নেতারা। কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় রূপালী নিজেও এখন অনেকটা সড়গড়, সপ্রতিভ। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কেটে-কেটে বললেন, ‘‘আমার স্বামী যত দিন ছিলেন কারও ক্ষমতা ছিল না এখানে বিজেপির পতাকা বার করার। সেই অবস্থাটা আমাকে ফেরাতে হবে।’’

তার উপরে রানাঘাটের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ তাপস মণ্ডলকে নিয়ে দলের অন্দরে ক্ষোভ ছিলই। এ বার তাঁর বদলে রূপালীকে প্রার্থী করে দল কিছুটা হলেও পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। অন্য দিকে, বিজেপিরও সাংগঠনিক সমস্যা রয়েছে রানাঘাটে। প্রথমে চিকিৎসক মুকুটমণি অধিকারীকে প্রার্থী করেছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু তাঁর সরকারি চাকরির পাঁচ বছর পূর্ণ না হওয়ার প্রশাসনিক গেরোয় শেষ পর্যন্ত প্রার্থী বদল হয়। জগন্নাথ সরকার প্রার্থী হন। কিন্তু এই কেন্দ্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বিজেপির বরাবরের কাঁটা। প্রার্থী-বিভ্রাটের জন্য বিজেপির অন্দরেই একাংশ তৃণমূল থেকে আসা এক প্রথম সারির নেতার ভূমিকার সমালোচনা করছেন। অগোছালো অবস্থা সামলে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। জগন্নাথ নিজে বলছেন, ‘‘মুকুটমণির বিষয়টায় দলের একটু ভুল হয়েছে। তবে আমাদের দলে গণতন্ত্র রয়েছে, ঐক্য রয়েছে। জয় আমাদের হবে।’’

নিজের অসন্তোষ লুকিয়ে রাখেননি মুকুটমণিও। সবকিছুর পরেও তিনি দলেরই সঙ্গে রয়েছেন জানিয়ে বলেছেন, ‘‘আমার বিষয়টা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব আরও আগে স্যাটে যেতে পারতেন।’’

রূপালীর ক্ষেত্রে সহানুভূতি তত্ত্বকে পাত্তা না দিয়ে জগন্নাথের বক্তব্য, ‘‘বিনাশকালে তৃণমূলের বুদ্ধি নাশ। সত্যজিৎ কেমন লোক ছিলেন সকলে জানেন। মানুষ এখন অত বোকা নয় যে, তাঁর পরিবারের জন্য সহানুভূতি দেখাবে। তৃণমূলের অনেক নেতাও একে সমর্থন করেন না। শুধু লোক দেখাতে রূপালির পাশে থাকছেন। কিন্তু মানসিক ভাবে নেই।’’

রানাঘাটে ভোটের ফলের অন্যতম নিয়ন্ত্রক মতুয়া ভোট। কারণ, এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোট মাত্র ৮% আর বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু এবং মতুয়া ভোট প্রায় ৫৫%। সত্যজিৎ বিশ্বাস খুন হওয়ায় ‘মতুয়া ফ্যাক্টর’-এ একটু পিছিয়ে পড়েছিল তৃণমূল। সত্যিই তৃণমূলের মতুয়া ভিত কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকবে নাকি আবেগের ভোটে তা ফুলেফেঁপে উঠবে, তা নিয়ে দাবি, পাল্টা দাবি অনেক, যার পরীক্ষা এ বারের ভোট।

যুযুধান দু’ পক্ষের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব এবং দলীয় চিহ্ন টিকিয়ে রেখে মুখরক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে সিপিএম ও কংগ্রেস। রানাঘাটের পার্টি অফিসে বসে সিপিএম প্রার্থী রমা বিশ্বাস বললেন, ‘‘পঞ্চায়েতে ওরা কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীক মুছে দিতে চেয়েছিল। মনোনয়ন জমা দিতে দিচ্ছিল না। আমরা তা হতে দিইনি। শত বাধার মুখেও প্রার্থী দিয়েছি। এই ভোট আমাদের কাছে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াই।’’ প্রায় একই কথা বলছেন কংগ্রেস প্রার্থী মিনতি বিশ্বাস। ‘‘আমাদের প্রচার করতে দিচ্ছে না, দেওয়াল লিখতে দিচ্ছে না। তবে নদিয়া কংগ্রেসের বহু পুরনো জায়গা। আমরাও লড়াই ছাড়ব না। ২০২১ আমাদের পাখির চোখ।’’

অতএব, শেষ বিচারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সেই জোড়া ফুল আর পদ্মফুলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement