মেয়ে সুকন্যার সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে। মাথা নিচু, দৃষ্টি মেঝের দিকে। ঘনঘন মাথা নাড়ছেন। মিনিট দুয়েক পরে মুখ তুললেন যখন, চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে এল। সেটা গোপন করার চেষ্টাও করলেন না। বললেন, ‘‘বড্ড ক্লান্ত লাগছে।’’
এই অনুব্রত মণ্ডল বড্ড অচেনা!
চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজানো থেকে শুরু করে, বিরোধীদের ভ্যানিশ করে দেওয়া, গুড়-বাতাসা কিংবা নকুলদানা খাওয়ানোর মতো চোখা চোখা সংলাপের জনক যিনি, তাঁর মুখে এ-সব আবার কী কথা! ধন্দ লাগল, কোনও নতুন চমক নাকি?
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কিন্তু বীরভূমের তৃণমূলের জেলা সভাপতির গলায় তখন কোনও নাটকীয়তা নেই। বললেন, ‘‘গত সপ্তাহে আমার মা চলে গিয়েছেন। এখন আমার স্ত্রী আইসিইউ-এ। আর পারছি না। মানসিক ভাবে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। খালি মনে হচ্ছে, কোথাও কি কিছু ভুল হয়ে গেল! অনেক দায়িত্বই পালন করা হয়নি।’’
অনুব্রতের স্ত্রী ছবি মণ্ডল ক্যানসারে আক্রান্ত। ফুসফুসের পাশাপাশি তা এখন ছড়িয়েছে মস্তিষ্কেও। গত ১৬ মাসের বেশি সময়টা কেটেছে রাজারহাটের এক ক্যানসার হাসপাতালে। ঘনিষ্ঠেরা বলেন, জেলার দাপুটে এই নেতার সব চেয়ে দুর্বল জায়গা তাঁর মেয়ে বুবাই ওরফে সুকন্যা। অনুব্রত বললেন, ‘‘আমার মেয়েটাই গোটা সংসারটা আগলে রেখেছে। ওর জন্যই ওর মা এখনও বেঁচে আছে। গত এক বছর ধরে আড়াই ফুট একটা খাটে মাকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকে ও। এক বছর ধরে রুগ্ণ মায়ের সেবা করে চলেছে।’’
মেয়ে সুকন্যার বয়স এখন ২৩। বাবাকে ঘিরে এত বিতর্ক, এত সমালোচনা, মেয়ে কিছু বলেন না? ফের অন্যমনস্ক দেখায় অনুব্রতকে। বললেন, ‘‘আমি যখন কোনও উল্টোপাল্টা কাজ করি, মেয়ে আর বৌ প্রবল ঝাড়তে শুরু করে আমাকে। কিছু দিন আগেও যখন আমার বৌ খবরের কাগজ পড়তে পারত, একচুল এ-দিক ও-দিক হলেই আমাকে অপমান করতে ছাড়ত না। বলত, এগুলো করতে লজ্জা করে না তোমার?’’ বিষণ্ণ শোনায় গলাটা।
অনুব্রত বলে চলেন, ‘‘দিদির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) কাছে যখন বকুনি খাই, মা-মেয়ে দু’জনেই একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘বেশ হয়েছে’। কিন্তু আমি তো ওই রকমই। দু’দিন ওই কাজটা বন্ধ রাখলাম, আবার যে-কে সেই।’’
সব বুঝেও তবে কেন এমন করেন? অনুব্রত মণ্ডলের অকপট উত্তর: ‘‘আসলে স্টেজে উঠলে আমার নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমি নিজেই বুঝতে পারি না আমি কী বলছি।’’ এত দিনের চেনা ছবিতে আবার এক বদল!
অচেনা আরও কিছু জায়গায়। যেমন তিন বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম তাঁর দল কটা আসন পাবে, বলেছিলেন ‘সবগুলো। মিলিয়ে নেবেন। রেজাল্টের দিন দুপুরে ফোন পাবেন আমার।’ সেই ফোন অবশ্য আসেনি। তবে এ দিন যখন প্রশ্ন করা হল লোকসভায় কটা আসন পেতে পারে তৃণমূল? বললেন, ‘‘৪২-এ ৪২ বললে পলিটিক্যালি কারেক্ট হত। কিন্তু সেটা আমি বলতে পারব না। কয়েকটা সিট হয়তো এ বার বেহাত হবে।’’ কটা? বললেন, ‘‘এ সব নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’’
আগে শতাব্দী রায়, গত বার দেব, মুনমুন সেন আর এ বার মিমি, নুসরতের ভোটে দাঁড়ানো— কী বলবেন? বললেন, ‘‘চমক তৈরির জন্য এগুলো করতেই হয়। দিদির নাম করেই ওঁরা জিতে যাবেন।’’ আসানসোলে মুনমুন সেনও জিতবেন? অনুব্রত বললেন, ‘‘হ্যাঁ জিতবেন। গত বারে দোলা সেন জেতেননি নিজের দোষে। দোলা সম্পর্কে লোকের অনেক অভিযোগ। ওঁর ব্যবহার নিয়ে, কাজকর্ম নিয়ে। আমি জানতাম দোলা জিতবে না। কিন্তু এ বার তো সেটা নয়। এ বার জিতে যাবে।’’
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে মূল্যায়নেও অনুব্রত একই রকম খোলামেলা। তাঁর মতে, ‘‘অভিষেক হল পরম্পরা। যেমন রাজীবের পরে রাহুল। মুলায়মের পরে অখিলেশ। এমনকী লালুর ছেলেও রাজনীতিতে। সে ভাবেই দিদির ভাইপো অভিষেক এসেছে।’’ তাঁর উত্থান ঘিরে দলে কোথাও কোনও প্রশ্ন নেই তো? এ বার হিসেবি জবাব, ‘‘না, ও সব কিছু আমি জানি না। আমি জেলার লোক, জেলায় থেকে খুশি। কলকাতায় কী হচ্ছে তার খবর রাখার কোনও দরকার আমার নেই। আমার সঙ্গে অভিষেক কখনও খারাপ কিছু করেনি।’’
দুপুর গড়াচ্ছে। বোলপুরে তাঁর বাড়ির একতলার ঘরের বাইরে পাত পেড়ে খাচ্ছেন কয়েক জন। কিছু ক্ষণ পরেই বেরতে হবে ময়ূরেশ্বরের নির্বাচনী সভায়। সেখান থেকে কলকাতার হাসপাতাল। তার পরে আবার বীরভূমে সভা। আবার নকুলদানা বিতর্ক, আবার নির্বাচন কমিশনের শো-কজ— সব ছেঁকে ধরবে তাঁকে।
প্রশ্ন করলাম স্ত্রীর অবস্থা এত খারাপ তা-ও সভায় যাবেন? অনুব্রতর জবাব, ‘‘আমি না গেলে লোক হবে না তো! তাই যেতেই হবে। আসলে কী জানেন, স্ত্রীকে নিয়ে পুরো ঘেঁটে আছি। তার পরে নির্বাচনী সভায় গিয়ে গরম গরম কথা বলতে ভাল লাগছে না। কিন্তু বলতেই হবে।’’
এখনও কি নকুলদানা খাওয়ানো চলছে? অনুব্রত বললেন, ‘‘গুড় বাতাসা থেকে বেরোতে নকুলদানা বলেছিলাম। সেখানেও বিতর্ক। আসলে আমি দেখছি আমি মুখ খুললেই সমস্যা। গৃহস্থ বাড়িতেও তো গরম কালে কোনও অতিথি এলে জলের সঙ্গে বাতাসা বা নকুলদানা দেওয়া হয়। কই তখন তো এত সমস্যা হয় না।’’ তা হলে আপনার ক্ষেত্রে হচ্ছে কেন? ‘‘ওই যে লোকে বলছে দানা মানে নাকি বোমা। অনুব্রত মানেই নাকি বোমা মারার কথা বলেছে। অনুব্রত নাকি সাধারণ কথা বলতেই পারে না।’’
প্রশ্ন করলাম এগুলো শুনলে কি খুব গর্ব অনুভব করেন? মনে হয়, নিজের দাপটটা দিব্যি বজায় রাখা যাচ্ছে? বদলে গেল চেহারাটা। বললেন, ‘‘দিদি না থাকলে আমি জিরো, সে কথা ঠিক। কিন্তু আমার একটা অহঙ্কারের জায়গা আছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ গলা তুলে কথা বললে সেটা আমি বরদাস্ত করতে পারি না। মনে হয় এত সাহস লোকটার! একে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে!'’
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। এক ঝটকায় খাট থেকে নেমে দাঁড়ান। চেনা অনুব্রত আবার যেন ফিরে আসেন স্বমহিমায়।
কলেশ্বরের মাঠে শেষ বিকেলে উপচে পড়ছে ভিড়। জনতা চেঁচাচ্ছে ‘কেষ্ট দা-কেষ্ট দা’! কেউ আবার বলছে ‘কেষ্টদা ঢাকের ডায়লগটা হয়ে যাক এক বার।’ হাতে ট্যাটু আঁকা, কানঢাকা চুলের এক তরুণ আবার বলে ওঠেন, ‘‘কেষ্টদা নকুলদানা রেডি আছে। কটাকে খাওয়াতে হবে এক বার বলে দাও বস্।’’
পুলিশ স্যালুট ঠুকছে। পাবলিক চেঁচাচ্ছে। অনুব্রত 'হাওয়া গরম' করা সংলাপ বলে উঠে যাচ্ছেন গাড়িতে। আগাগোড়াই সেই হম্বিতম্বি। আগাগোড়াই ‘আমি ছাড়া আর কে আছে এই তল্লাটে’ টাইপের হাবভাব।
সব গুলিয়ে যাচ্ছে আবার। ঘণ্টাকয়েক আগে ঘরে দেখা অনুব্রতের সঙ্গে মেঠো সভার এই ‘কেষ্টদা’কে মেলানো সত্যিই কঠিন।