নির্বাচন কমিশনের দফতরে জিজা ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র
তাঁর অদম্য জেদের কাছে হার মেনেছে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা। কুর্নিশ করেছে গোটা দেশ, গোটা বিশ্ব। এ বার সেই জিজা ঘোষের মুকুটে আরও এক পালক। লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বা ‘দূত’ জিজা। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত জিজা। কিন্তু তার চেয়েও বড় পরিচয়, তিনি সমাজকর্মী। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের লড়াইয়ে যিনি নিজে উদাহরণ, অন্যদের কাছে যিনি রোল মডেল। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত কাউকে নির্বাচন কমিশনের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ করা শুধু এ রাজ্যেই নয়, গোটা দেশেই এই প্রথম এবং নজিরবিহীন। ভোটারদের সচেতন করা থেকে নাম নথিভুক্তকরণের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে লোকসভা ভোটের মুখে জিজার অহ্বান, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট দিন।’’
জিজার সঙ্গে কমিশনের এই জোটবন্ধন অবশ্য এক দিনে হয়নি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের আরও বেশি করে বুথমুখী করার ভাবনা এবার গোড়া থেকেই ছিল কমিশনের। ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় থেকেই তাই জিজার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কমিশনের কর্তারা। জিজা সম্মতি দেওয়ার পর কলকাতার মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতর কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে প্রস্তাব পাঠায়। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই কাজ শুরু করেন জিজা। কিছু দিন আগেই জিজাকে এ রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। জিজার বক্তব্য, ‘‘এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা অভিজ্ঞতা।’’ বেশি কথা বলতে সমস্যা হলেও দায়িত্ব পেয়ে যে তিনি ভীষণ খুশি, সেটা ফুটে উঠেছে তাঁর অভিব্যক্তি থেকেই।
ভোটার তালিকায় নাম সংযোজন-বিয়োজন ও সংশোধনের কাজ শেষ। সেখান থেকে আলাদা করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ভোটারদের চিহ্নিত করার কাজও প্রায় সেরে ফেলেছে কমিশন। এ বার নজর বুথে। আনন্দবাজারকে জিজা জানালেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ভোটারদের জন্য এক গুচ্ছ সুপারিশ করেছেন তিনি। বাড়ি থেকে বুথ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া এবং ভোট দেওয়ার পর বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে সেই হুইল চেয়ার নিয়ে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করা যায়, সেগুলির মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য। জিজা বলেন, ‘‘আমি যে সব বন্দোবস্ত করার কথা বলেছি, কমিশন সেগুলির ব্যবস্থা করেছে। তাতে ভোটাররা আরও বুথমুখী হবে।’’
আরও পডু়ন: বিজেপির প্রতি জনসমর্থন দেখে ভয় পেয়েছেন দিদি, কোচবিহারের সভায় দাবি মোদীর
আর ভোটের দিন? জিজা জানালেন, কমিশনের বন্দোবস্তগুলি ঠিকঠাক ভাবে পালন করা হচ্ছে কি না, তার উপর কমিশনের পাশাপাশি তিনিও নজর রাখবেন। বুথে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথাও বলতে পারেন তিনি। ‘‘প্রয়োজনে বাড়ি গিয়ে প্রতিবন্ধী ভোটারদের বুথে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করবে কমিশন। বুথেও তাঁরা যাতে স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পারেন, সেই দায়িত্ব নেবে কমিশনের।’’
কোনও কারণে গর্ভে থাকার সময় বা জন্মের সময় শিশুর মাথায় অক্সিজেন কম সরবরাহ হলে সাধারণত সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত হয় সেই শিশু। আক্রান্তদের হাঁটাচলা স্বাভাবিক নয়। কথা যেমন অস্পষ্ট, তেমনই বলতেও কষ্ট হয়। কিন্তু সে সব কোনও কিছুই দমাতে পারেনি জিজাকে। লা মার্টিনিয়ার স্কুল এবং পরে কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পলসি থেকে পড়াশোনা করেছেন৷ সমাজতত্ত্বে অনার্স করেছেন প্রেসিডেন্সি থেকে৷ পরে দিল্লি স্কুল অফ সোশ্যাল ওয়ার্কে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। কিন্তু সেখানেই না থেমে ২০০৬ সালে ব্রিটেনের লিডস ইউনিভার্সিটি ডিসঅ্যাবিলিটি নিয়ে দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পলসি-র শিক্ষক।
আরও পডু়ন: বারাণসীর গঙ্গা পরিষ্কার করতে পেরেছেন? বাংলার দিকে তাকাচ্ছেন? ময়নাগুড়িতে মোদীকে তোপ মমতার
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক এই পরিচয়ের বাইরের জগতেই বরং বেশি বিচরণ জিজার। প্রায় দু’দশক ধরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য কাজ করে আসছেন কলকাতার বাসিন্দা জিজা। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী মহিলাদের অধিকার আদায় এবং সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর লড়াইয়ে তিনি পথিকৃৎ। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার। তাঁর এই কর্মকাণ্ড এবং জীবন সংগ্রাম নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র ‘আই অ্যাম জিজা’ পেয়েছে ভারত সরকারের জাতীয় পুরস্কার৷
নিজের অদম্য জেদের কাছে তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছ। কিন্তু সমাজের সঙ্গে লড়াইটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পাইস জেট কাণ্ডের কথা এখনও নাড়া দেয় জিজাকে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে গোয়ায় একটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বিমানে ওঠার পরও তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র তিনি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত এই কারণে। ২০১২ সালের সেই ঘটনাতেও তিনি উচিত শিক্ষা দিয়েছেন ওই বিমান পরিষেবা সংস্থাকে। লড়াই করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে স্পাইস জেটকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। তখনও তিনি বলেছিলেন, এই জয় শুধু তাঁর নয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরা বিমানেও মর্যাদা পেলেন, এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দ।
অনেকটা পথ পেরিয়ে তবে স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর সংগ্রাম। নির্বাচন কমিশনে তাঁর এই নতুন ভুমিকাও যে প্রতিবন্ধীদের নতুন করে অধিকার আদায়ে অনুপ্রাণিত করবে, সেটা হয়তো এখনই বলে দেওয়া যায়। তবে জিজার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সবাইকে ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন। আর বলছেন, ‘‘কমিশন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, আমি পালন করব।’’