আবু হাসেম(ডালু)খান চৌধুরী।
ফাঁকা কোতুয়ালির বাড়িতে তাঁর কাজের ঘরের সামনে রাখা ছিল গাড়িটা। ভরা প্রচারের মরসুমে প্রার্থীদের যখন নাভিশ্বাস উঠে যায়, তিনি তবে কোথায়?
খোঁজ করে জানা গেল, প্রচারের মাঝেই হুট করে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন! সেখান থেকে কলকাতা হয়ে আবার চলে এসেছেন মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে। কিন্ত সেখানেও মিটিং-মিছিল করতে তাঁকে কেউ তেমন দেখেনি। তা হলে? তিনি মিটিং-ই করেছন। তবে ডেরায় বসে নানা জনের মুখোমুখি হয়ে।
আর পাঁচ জনের চেয়ে মালদহ দক্ষিণের কংগ্রেস প্রার্থীর হালচাল বেশ খানিকটাই আলাদা। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে জল-মুড়ি বা ছাতুর শরবত খেয়ে বেরিয়ে পড়ার দৌড়ে তিনি নেই। ‘তোমাদের লোক’ বলে প্রমাণ দিতে আর পাঁচ জন প্রার্থী যখন গরুর গাড়ি থেকে ভ্যান রিকশা— যা দেখছেন, তাতেই চেপে বসছেন, তিনি এ সবে নেই। মালদহের গরমে সামার কোট চাপিয়ে তাঁর নিজের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় হাজির হবেন তিনি।
হা-ক্লান্ত হয়ে দৌড়োদৌড়়ির বদলে যেখানে দেখছেন সমস্যা, সেখানে নিভৃতে মুখোমুখি বসে মীমাংসা করতেই এ বার নজর বেশি আবু হাসেম(ডালু)খান চৌধুরীর। বিখ্যাত দাদা বরকত গনি খানের মৃত্যুর পরে কোতুয়ালির এই বাসিন্দাকে আর হারানো যায়নি। কিন্তু এ বার কি তিনি গোলমালে পড়েছেন? কানে ঈষৎ খাটো, তবু জয়-পরাজয়ের কথা উঠলেই তুড়ি মেরে আশঙ্কা উড়িয়ে ডালুবাবু বলেন, ‘‘ধুর! জিতব আমরাই। মালদহের মানুষ কংগ্রেসকে জানে, বিশ্বাস করে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মুখে তিনি মানবেন না ঠিকই। তবে কোতুয়ালির অন্দরের খবর বলছে, পঞ্চায়েতের ভোটের পর থেকে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটে মালদহ জেলায় কোনও আসন জেতেনি তৃণমূল। ডালুবাবুর লোকসভা এলাকার মধ্যে অবশ্য মালদহের বৈষ্ণবনগরে বিজেপি এবং মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে দু’হাজার ভোটে তৃণমূল জিতেছিল। অথচ গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে সেই মালদহে সব ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছে তৃণমূলই! এমনকি, বরকত, রুবি নূর, মৌসম নূর, আবু নাসেম (লেবু)খান চৌধুরীর হাত ঘুরে এখন ঈশা খান চৌধুরী যে সুজাপুরের বিধায়ক, সেখানেও পঞ্চায়েতে তৃণমূলের রমরমা। লোকসভা ভোটে ‘গুন্ডামি’ আটকানোর কথা বলেই ডালুবাবু দিল্লিতে কমিশনের কাছে মালদহের জন্য ৬০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করে এসেছেন।
আবার এরই পাশাপাশি মালদহ জুড়ে বিজেপির নামে বেশ গুঞ্জন আছে। ইংলিশবাজারের মতো শহুরে এলাকা এবং বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে বিজেপির প্রভাব আগে থেকেই যথেষ্ট। এখন কালিয়াচকের মতো ‘অপরাধ-কুখ্যাত’ জায়গায় গেরুয়া শিবির আরও মেরুকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাদের নতুন প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরে অস্বস্তিও আছে। রাজ্য বা জেলা বিজেপির অধিকাংশের কাছেই তিনি অপরিচিত। তার উপরে তাঁর স্বামী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে উপদেষ্টা পদে থাকা আর কে মিত্রকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছে তৃণমূল। শ্রীরূপা প্রচারে বেরোচ্ছেন পাঁজি-পুঁথি দেখে। কোথাও ‘স্বচ্ছ ভারত’ করতে ঝাঁট দিচ্ছেন, কোথাও গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। তাঁর মুখে নতুন ভারত গড়া আর তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস, ভোট লুঠ’ করে পঞ্চায়েতে জেতার কথা।
তৃণমূল এবং বিজেপির মোকাবিলায় ডালুবাবুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বামেরা। রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বামের আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার পরে ৪০টি আসনে বামফ্রন্টের প্রার্থী আছে, বহরমপুরেও ফ্রন্ট-বহির্ভূত ভাবে আরএসপি আছে। কিন্তু ডালুবাবুর আসন বামেরা ছেড়ে দিয়েছে। মালদহ জেলা সিপিএম এমনিতেই জোটপন্থী। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও এ বার মালদহ দক্ষিণে কংগ্রেসকে সমর্থনের বার্তা স্পষ্ট করেছেন। বামেদের ভোট তাঁর বাক্সে গেলে স্বস্তিতে থাকবেন ডালুবাবু। যিনি বরাবরই বলছেন, ‘‘জোটটা দরকার ছিল।’’ তবে মালদহ উত্তরে বাম প্রার্থী আছে, মহানন্দার অন্য পারে দক্ষিণে নেই— এই নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিও আছে!
গত বারের মতো এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন। পেশায় চিকিৎসক, সজ্জন মানুষ, অকারণ অতি-কথনে যান না। নিজে খাটছেন, সংখ্যালঘু ভোটে নজর রেখে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মতো নেতা-মন্ত্রীরাও মালদহ দক্ষিণে প্রচার করে যাচ্ছেন। মোয়াজ্জেমের বক্তব্য স্পষ্ট, ‘‘বিজেপিকে হারিয়ে কেন্দ্রে নতুন সরকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্ণায়ক শক্তি করে তুলতে আমাদের সমর্থন করুন।’’
পঞ্চায়েত বা বিধানসভায় যা-ই হোক, সেই ১৯৮০ সাল থেকে মালদহের গ্রামাঞ্চল বরকতের চিহ্নে লোকসভায় আস্থা রেখে আসছে। সেই ‘ট্র্যাডিশন’ বদলাতে চান মোয়াজ্জেম-শ্রীরূপা। ঘরের ভিতরে বৈঠক করে করে ঘর গোছাচ্ছেন ডালুবাবুও।