Kanchanjunga Express Accident

‘কোনও বাড়িতে রান্না হয়নি, হয়নি কুরবানিও, গ্রামের যুবক ও মহিলারা ছুটেছিলেন দুর্গতদের সাহায্য করতে’

সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ কানফাটানো আওয়াজের পরে, তাঁরা দেখেন, মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপরে উঠে গিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একটি কামরা! ধাক্কায় প্রায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে আর একটি।

Advertisement

শুভঙ্কর পাল ও নীতেশ বর্মণ

ফাঁসিদেওয়া ও শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৪ ০৮:০১
Share:

শিলিগুড়ি মহকুমার রাঙাপানি এলাকার ছোট নির্মল জোতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ও একটি মাল গাড়ীর সংঘর্ষের পর ঘটনাস্থলের ছবি। ছবি:বিনোদ দাস।

Advertisement

প্রথমে বিকট শব্দ। তার পরে ট্রেন লাইনে নজর পড়তেই চমকে উঠেছিলেন ওঁরা। সোমবার ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানির কাছে, জালাস গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট নির্মল জোতের বাসিন্দাদের অনেকেরই দিন শুরু হয় আঁতকে ওঠা দিয়ে। সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ কানফাটানো আওয়াজের পরে, তাঁরা দেখেন, মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপরে উঠে গিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একটি কামরা! ধাক্কায় প্রায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে আর একটি। যাত্রীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল গ্রাম জুড়ে। প্রথমে স্থানীয়েরাই উদ্ধার কাজ শুরু করেন। গ্রামবাসীরা বাড়ি থেকে জল, চাদর নিয়ে আসেন। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া একটি কামরার ভিতর থেকে যাত্রীদের বার করে আনা হয়। রেলে খবর যাওয়ার পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায় এনডিআরএফ কর্মীদের। ট্রেন দুর্ঘটনার খবর চাউর হতেই আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও আসতে শুরু করেন। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো শুরু হয়। গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ আজিবুল, মহম্মদ রাহুলেরা বলেন, ‘‘মানুষের আর্তনাদ শুনে, দেহাংশ রেললাইনে পড়ে থাকতে দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।’’

এলাকার মসজিদের ইমাম মহম্মদ বসিরউদ্দিন বলেন, “কোনও বাড়িতে রান্না হয়নি। সোমবার কুরবানি ইদ ছিল। কোনও বাড়িতে কুরবানি হয়নি। যুবক, মহিলা সকলে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। জখম যাত্রীদের কোলে নিয়ে মেডিক্যালে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন গ্রামবাসীরা। পরে উদ্ধারকারী দল পৌঁছয়।” পঞ্চাশেরও বেশি অ্যাম্বুল্যান্স দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। আহতদের অ্যাম্বুল্যান্সে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও অন্য হাসপাতালে
পাঠানো হয়।

Advertisement

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ দিন সকালের পরে দুর্ঘটনাস্থল থেকে একের পরে এক অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকছে। তা থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মীরা বার করে আনছেন কখনও মাথা থেঁতলে যাওয়া, হাত, পা কাটা, রক্তাক্ত শরীর। রাস্তা জুড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ট্রলি থেকে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পরিচিতেরা নিখোঁজ রেলযাত্রীদের খোঁজ করতে এসেছেন। হাসপাতালের এক নার্সের মোবাইলে এক জন ছবি পাঠিয়েছেন। তিনি রেলের কর্মী। তাঁর আত্মীয় কান্দি মহকুমা হাসপাতালে কাজ করেন। সেই সূত্রে পরিচিতদের মাধ্যমে হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছিলেন রেল দুর্ঘটনায় জখমদের মধ্যে রয়েছেন কি না। সে ছবির সঙ্গে ডেপুটি সুপারের কাছে থাকা মৃতদের এক জনের ছবির মিল পেতেই বুকটা কেঁপে ওঠে সকলের। পরিবারকে হাসপাতালে আসতে বলা হয়। মৃত ওই ব্যক্তি রেলকর্মী শঙ্করমোহন দাস।

জরুরি বিভাগে শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন আর মেয়ের কথা ভেবে কাঁদছেন ছবি মণ্ডল। তাঁরও চোট লেগেছে। বলছেন, ‘‘মেয়ে ভাল নেই। ওর রক্ত লাগবে। ওর কী হল?’’ তাঁর ছ’বছরের মেয়ে স্নেহা গুরুতর জখম। তার অস্ত্রোপচার হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় ছিলেন। আর এক যাত্রী শান্তনু ভুঁইয়ার ডান পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। বলেন, ‘‘হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ এবং কেঁপে উঠল ট্রেনটা। ছিটকে পড়ি। পায়ে চোট লাগে। খুব জোর রক্ষা পেয়েছি।’’

এক-এক সময় শোনা যাচ্ছিল স্বজনহারানো বাড়ির লোকের হাহাকার। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশিস দে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। তাঁর এ দিন ‘ডিউটি’ ছিল শতাব্দী এক্সপ্রেসে। কোনও কারণে তিনি তা বদলে কাঞ্জনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে নিয়েছিলেন। তাঁর পরিবার শিলিগুড়ি শহরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বলাকার বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ে কান্নায় বেঙে পড়েছেন। আত্মীয় পঙ্কজ দে বলেন, ‘‘সরকারের উচিত, সিগন্যালগুলোকে ঠিক করা। না হলে এমন অনেক দুর্ঘটনা হবে।’’ বিকেল ৪টা নাগাদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে বলেন, “কারণ খোঁজা হচ্ছে। তবে যে কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে, সে কারণে আগামীতে যাতে আর দুর্ঘটনা না ঘটে তা দেখা হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement