—প্রতীকী ছবি।
দেশ বাঁচাতে বিজেপিকে হারানোর ডাক দেওয়া হয়েছে। রাজ্য বাঁচাতে তোলা হয়েছে ‘তৃণমূল হটাও’ স্লোগান। কিন্তু ভোটে তেমন কিছুই সুবিধা হচ্ছে না। নেতিবাচক প্রচারের ধারাকে পিছনে ঠেলে এ বার ‘ইতিবাচক’ বক্তব্যে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের প্রার্থীদের বড় অংশ। দলের কাছে এমন প্রস্তাবই দিয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গেই তাঁদের কথায় উদ্বেগ উঠে আসছে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে সংগঠনের দৈন্যদশা নিয়ে।
দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিন পরে ‘মিশন ৩৬০’ মন্ত্রের কথা শোনা গিয়েছিল মহম্মদ সেলিমের মুখে। বিকল্প পাঠশালা, জনৌষধি কেন্দ্রের মতো সাধারণ মানুষের জন্য উপযোগী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনায় জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই পরিকল্পনা অল্প-বিস্তার প্রচারেও এনেছিল দল। কিন্তু বড় নির্বাচন আসতেই প্রচারের মূল জায়গা আবার নিয়ে নিয়েছে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধিতা। ভোটে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এবং ‘পারফরম্যান্সে’র আত্মমূল্যায়নের প্রেক্ষিতে সিপিএম প্রার্থীদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, তাঁরা কী করতে চান, কী করতে পারেন, সেই কথা বেশি করে বললে হয়তো মানুষ সাড়া দিতে পারেন। লোকসভা ভোটের পরে রাজ্য কমিটির বৈঠকে এবং প্রার্থীদের নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আলোচনায় সিপিএমের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এই মত পেশ করেছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর।
লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে এ বার প্রচারে ভাল সাড়া পেয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থীরা। সভা-মিছিলে ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তার প্রতিফলন ভোট-বাক্সে পড়েনি। রাজ্যে এ বার ২৩টি লোকসভা আসনে প্রার্থী ছিল সিপিএমের। তার মধ্যে রাজ্য সম্পাদক সেলিম ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বাদ দিয়ে অধিকাংশ প্রার্থীই তুলনায় নতুন বা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। ভোটের পরে মূলত দলের তরুণ অংশকে যাতে হতাশা না গ্রাস করে, সে দিকে নজর রেখেই পরাজিত প্রার্থীদের ডেকে আলাদা করে তাঁদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। দুই অভিজ্ঞ নেতা সেলিম ও সুজন সেই আসরে প্রার্থী হিসেবে নিজেদের কথা বলেননি। দলের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্যও আলোচনায় ছিলেন। সূত্রের খবর, শ্রমিক-কৃষকের মতো শ্রেণিকে পাশে রেখে আরও আন্দোলনের সওয়াল করেছেন বেশির ভাগ প্রার্থীই। বলেছেন বুথ স্তরে সংগঠনকে যাওয়ার কথা। প্রচারে লোক হলেও নিচু তলায় লড়াই বা বুথ আগলানোর লোক যে পাওয়া যাচ্ছে না, প্রার্থীদের ময়না তদন্তে উঠে এসেছে সেই সমস্যাও।
তরুণ প্রার্থীদের মধ্যে দীপ্সিতা ধর বা প্রতীক-উর রহমান আলিমুদ্দিনের বৈঠকে ছিলেন না। তবে সৃজন ভট্টাচার্য, জাহানারা খান, এস এম সাদী, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, সোনামণি টুডুরা ছিলেন। এক প্রার্থীর কথায়, ‘‘প্রতি বার ভোট হয়ে যাওয়ার পরে আলোচনা শুরু হয়ে যায়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে কি বেশি বলা হয়ে গেল? বিজেপির বিরুদ্ধে কি কম বলা হল? আবার উল্টোটাও হয়। এর সবটাই নেতিবাচক প্রচার। তার চেয়ে আমরা কী করতে চাই, সেই ইতিবাচক বক্তব্যে জোর দিয়ে দেখা যেতে পারে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালানো একটা উদাহরণ। ভোটের সময়ে এ বার যে মহিলাদের নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা হয়েছিল, সেটাও ভাল ছিল। এই দিকগুলো প্রচারে গুরুত্ব পেলে ভাল হয়।’’ দলের বর্ষীয়ান নেতারা অবশ্য মনে করাচ্ছেন, বাম আমলে বিরোধীদের হাতে জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু পুরসভা ছিল। নিজেদের কাজকে প্রচারে তুলে আনার সুযোগ তারা পেত। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় বিরোধীদের হাতে স্থানীয় স্তরের সরকারি সংস্থা প্রায় কিছুই নেই। ফলে, নেতিবাচক প্রচারই বেশি হয়ে যায়।
দক্ষিণবঙ্গের একটি আসনের সিপিএম প্রার্থীর মতে, ‘‘দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে বহু জায়গায় সংগঠন ছাড়াও বিজেপি হাওয়ায় ভোট পাচ্ছে! বামপন্থীদের এই রকম কোনও হাওয়া নেই। আমাদের ভোট পেতে হবে মূলত সংগঠনে ভরসা করেই। নিচু তলায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে সেই সংগঠনের হাল শোচনীয়!’’ জঙ্গলমহলের এক প্রার্থী বৈঠকে বলেছেন, ওই অঞ্চলে এক সময়ে মাওবাদী আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল দলকে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার পরেও সংগঠনের জং ছাড়েনি! একই দিনে বারুইপুরে বসেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের বৈঠক। সূত্রের খবর, জেলায় সংগঠনের হাল নিয়ে সেই বৈঠকেও প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গেই জয়নগর, মথুরাপুরের মতো আসনে আইএসএফের থেকে পিছিয়ে থাকার প্রসঙ্গ টেনে নওসাদ সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ নিয়েও সরব হয়েছেন একাধিক নেতা।