জলে কংগ্রেস! ডাঙায় তৃণমূল! দুইয়ের মাঝে গভীর সঙ্কটে তাঁরা!
কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোটে লড়তে বামফ্রন্টের শরিক নেতাদের অনেকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে এবং মানুষের চাহিদা মাথায় রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন তাঁরা। আর সেই খোলা দরজা দিয়েই বান এসে এখন প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চলেছে তাঁদের!
বছরের পর বছর ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি বা সিপিআইয়ের মতো বাম শরিক দল লড়াই করে, এমন আসন এ বার দাবি করছে কংগ্রেস। আরএসপি আবার কংগ্রেসের আসনে প্রার্থী দিয়ে বসে আছে। পাল্টা কংগ্রেসও শরিকদের পাঁচ বছর আগের জেতা আসনে হাত দিতে চাইছে! জোট ভাঙতে না চাইলেও দলের অস্তিত্ব বাঁচানোর দায়ও আছে শরিক নেতৃত্বের। তাই তাঁরা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন এমন ‘সর্বগ্রাসী’ সমঝোতা আটকানোর! আর এই টানাটানি দেখেই বাইরে ওৎ পেতেছে তৃণমূল! কোথাও বামফ্রন্টের মধ্যে বিক্ষুব্ধ অংশের গন্ধ পেলেই হাজির হয়ে যাচ্ছে শাসক দলের বাহিনী। কখনও প্রলোভন নিয়ে, কখনও প্ররোচনা দিতে! যদিও প্রকাশ্যে সে কথা মানতে তৃণমূল নেতৃত্ব নারাজ। কিন্তু শরিক নেতারা পড়েছেন আতান্তরে। কংগ্রেসের দাবিমতো সব আসন ছেড়ে দিলে দলের সাইনবোর্ডটাও প্রায় নামিয়ে রাখতে হয়! আবার জেদ ধরে থাকলে জোট ভাঙার নৈতিক দায় ঘাড়ে এসে তো প়ড়েই। উপরন্তু তৃণমূল দল ভাঙাবে! এবং সেই সঙ্গেই তৃণমূলকে তলে তলে সাহায্য করার বদনামও জুটবে!
বহরমপুরে বসে রবিবার সন্ধ্যায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আরও ২৩টি আসনে লড়ার ঘোষণা করেছেন শুনে প্রায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন ক্ষিতি গোস্বামী, মনোজ ভট্টাচার্য, হাফিজ আলম সৈরানিরা। আরএসপি-র জেতা আসন মালতীপুর, ভরতপুর বা ফ ব-র হাতে-থাকা হরিশ্চন্দ্রপুরেও ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ হবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। হতাশ মনোজবাবু তাই বলে ফেলেছেন, ‘‘আর পেরে উঠব কি না, জানি না! সমঝোতা রক্ষা করতে হলে আমাদেরই হয়তো এর পরে আলিমুদ্দিনে গিয়ে বলে আসতে হবে, আমরা একটা আসনও চাই না! এ বারের ভোটটা আমরা লড়ছি না। আপনারাই বুঝে নিন!’’ প্রায় একই সুর হাফিজেরও। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘একটা কোনও সূত্র ধরে তো এগোতে হবে। কেউ কারও জেতা আসন নেব না বলে যদি ঠিক করি, তা হলে সেটাই মানতে হবে। প্রথমে আমাদের জয়পুরে প্রার্থী দেবে বলছিল কংগ্রেস। সেটা ছেড়ে দিতে রাজি হল তো হরিশ্চন্দ্রপুর নিল!’’
কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য দাবি করছেন, শরিকদের নিজস্ব তাকত বলতে কিছু নেই। সিপিএমের জোরেই তারা ক্ষমতাবান। এই টানাটানির সময়ে শরিকদের দাবি তাই ঝেড়ে ফেলা উচিত সিপিএমের! দু’মাসের বন্ধুর জন্য প্রয়োজনে চল্লিশ বছরের সঙ্গীদের ছেড়ে দিতে হবে সিপিএমকে, এমন কথাও বলছেন অধীর-ঘনিষ্ঠ নেতারা। এতই যখন টানাপড়েন, কংগ্রেস কেন আরএসপি-র মতো দলের সঙ্গে মুখোমুখি বসছে না? তাদের সঙ্গে কথা বলে কেন আপসে প্রার্থী প্রত্যাহার করানোর পথে যাচ্ছে না? স্বয়ং অধীর যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘আমি তো এক জনের (সিপিএম) সঙ্গে কথা বলেছি। জনে জনে শরিক দলের সঙ্গে কথা বলতে পারব না! আমি আমার কাজ করে দিয়েছি। আমি তো আগেই বলেছি ২-৪% আসনে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হতে পারে।’’
কঠিন অবস্থায় পড়েছে আলিমুদ্দিনও! দিল্লিতে প্রকাশ কারাটদের সঙ্গে প্রবল লড়াই করে সমঝোতার ছাড়পত্র আদায় করা হয়েছে। এখন কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে মান থাকে না! এই দুর্বলতা বুঝে নিয়ে রবীন দেবদের উপরে চাপ বাড়াচ্ছেন অধীরেরা। আর ক্ষিতিবাবুদের রাগ গিয়ে পড়ছে রবীনবাবুদের উপরে! অবস্থা বুঝে এই ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন সিপিএম নেতারা। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য ঘরোয়া আলোচনায় শুধু বলছেন, ‘‘বাম ঐক্য অটুট রেখেই বৃহত্তর ঐক্যের পথে যেতে চাইছি। আমরা সব রকম চেষ্টা করছি। কার কী সীমাবদ্ধতা, সেটা প্রত্যেককেই বুঝতে হবে।’’
কংগ্রেসের চাপ যত বাড়ছে, আরএসপি নেতারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন। আরএসপি-র প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহচ্ছায়ায় মুর্শিদাবাদের এক ডাকাবুকো তরুণ রাজনীতির মাঠে পাকা জায়গা পেয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর দৌড় ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ্য রাজনীতির আঙিনায়। দেবব্রতবাবু এখন রোগশয্যায়। আর তাঁর দলের একের পর আসন ঘিরেই সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছেন সে দিনের তরুণ। বলছেন, যা বলার সিপিএমকে বলবেন, আরএসপি-কে নয়।
সে দিনের সেই তরুণের নাম? অধীররঞ্জন চৌধুরী!