পুরসভা নির্বাচনে অবাধ ভোট ‘লুঠে’র প্রতিবাদে কার্যত শাসক দলের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে গেল সব বিরোধী! পুরভোটের নামে প্রহসনের প্রতিবাদে বামফ্রন্ট ৩০ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার রাজ্যে ১২ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। একই কারণে সেই দিনই পৃথক ভাবে বাংলা বন্ধ ডাকল বিজেপি-ও। সরাসরি বন্ধে সামিল না হলেও তাঁরা ধর্মঘটের বিরোধিতা করছেন না বলে জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশেন, পিডিএসের মতো ছোট বামপন্থী দলগুলিও ফ্রন্টের ধর্মঘটকে সমর্থন করছে। ফলে, বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছরে এই প্রথম শাসক দলকে একঘরে করে দিয়ে ময়দানে নামছে গোটা বিরোধী পক্ষ।
পুরভোট ঘিরে নানা অভিযোগে বিদ্ধ তৃণমূল এখন পাল্টা চেষ্টা করছে, বিরোধীদের সম্মিলিত আহ্বানকে অনৈতিক রামধনু জোটের প্রয়াস হিসাবে দেখাতে। ধর্মঘটের বিরোধিতা করেই সোমবার তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে! এ রাজ্যে তৃমমূলের বিরুদ্ধে তিন জন মিলে অপপ্রচার, কুৎসা করেছে। অনেক দিন ধরেই আমরা তা বলে আসছি। ওঁরা নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়েই প্রমাণ করলেন, আমরা যা বলেছিলাম, তা সঠিক!’’
বিরোধী নেতৃত্ব অবশ্য শাসক দলের তোপ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁদের যুক্তি, সার্বিক ভাবে মানুষের অধিকার যখন বিপন্ন, তখন দল-মত-নির্বিশেষে সর্ব স্তরের প্রতিবাদই স্বাভাবিক। পুরভোটের দিনও শিলিগুড়ি-সহ বহু জায়গায় নিচু স্তরে কার্যত জোটবদ্ধ হয়েই শাসক দলের তাণ্ডব মোকাবিলা করেছিল বিরোধীরা। ধর্মঘটে সেই লড়াই-ই আরও প্রসারিত হল। তবু রাজনৈতিক ভাবে বামেদের ডাকা ধর্মঘটকে সরাসরি সমর্থন করা বিজেপি-র পক্ষে অসুবিধাজনক ছিল। আবার শাসক দলের ভোট লুঠের প্রতিবাদে বামফ্রন্ট এবং শ্রমিক সংগঠনগুলি যখন ধর্মঘট করছে, সেই সময় বিজেপি নিষ্ক্রিয় থাকলে জনমানসে তাদের সম্পর্কে ভুল বার্তা যেতে পারতো। এই প্রেক্ষিতেই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ৩০ তারিখ পৃথক ভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছেন। রাহুলবাবু এ দিন বলেন, ‘‘আমরা অন্য দিন বন্ধ ডাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে মানুষের অসুবিধা হত। আর্থিক ক্ষতিও হত। তাই ৩০ এপ্রিলই বন্ধ ডাকা হচ্ছে।’’ তবে রেল এবং ডাক-সহ জরুরি পরিষেবাকে বন্ধের আওতার বাইরে রাখছে বিজেপি। রাহুলবাবু বলেন, ‘‘বন্ধ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নয়। তাই রেলকে আমরা বন্ধের বাইরে রাখছি। তবে যাত্রীদের কাছে আবেদন, আপনারা রেলে চড়বেন না। ফাঁকা রেল চলুক!’’ বিজেপি একই দিনে ধর্মঘট ডাকায় তাকে স্বাগত জানিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে সর্ব স্তরের মানুষের সর্মথন দরকার। যাঁরা শাসকের বিরুদ্ধে ডাকা এই ধর্মঘটে যোগ দেবেন, তাঁদের স্বাগত জানাই।’’ তাঁর যুক্তি, ১৯৭৪ সালে ঐতিহাসিক রেল ধর্মধটেও সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সূর্যবাবু এ দিনই বার্তা দিয়েছেন, ‘‘জোর করে আমরা কাউকে ধর্মঘটে সামিল করব না। কিন্তু কেউ জোর করে ধর্মঘট ভাঙলে দল-মত-নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে হবে।’’ প্রয়োজনে তিনি কি ঝান্ডা ছেড়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রতিবাদে সামিল হতে বলছেন? সূর্যবাবুর জবাব, ‘‘অবশ্যই!’’ পুরভোটে তৃণমূলের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ বাম ও বিজেপি যখন শাসকের উপরে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, কংগ্রেসের তরফে অধীরবাবু তখন চেষ্টা চালিয়েছেন কিছুটা মধ্যপন্থী অবস্থান নেওয়ার। অধীরের বক্তব্য, ‘‘অন্য দলের স্বতন্ত্র কর্মসূচিতে সামিল হওয়ার জন্য আমরা বসে নেই! কংগ্রেস নিজেদের মতো করে আন্দোলন করছে, করবে।’’ কিন্তু যে বাম বা বিজেপি-র মতো একই অভিযোগ তো কংগ্রেসেরও? অধীরের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘অভিযোগ এক হলে আন্দোলনের পথও এক হবে? ওরা বন্ধ ডেকেছে বলে আমাদেরও বন্ধ ডাকতে হবে?’’ অধীর এ কথা বললেও শ্রমিক সংগঠন হিসাবে আইএনটিইউসি কিন্তু ধর্মঘটে সামিল। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও বলেছেন, কংগ্রেস কর্মীরা ধর্মঘট সমর্থনে পথে নামবেন! এ সবের জেরে কংগ্রেসের অন্দরেই কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। দলের একাধিক রাজ্য নেতাই মনে করছেন, ধর্মঘটের বিরোধিতা করার যখন জায়গা নেই, তখন ধোঁয়াশা না রেখে আলাদা করে বন্ধ ডেকে দিলেই ভাল হতো! শাসক বনাম বিরোধী মেরুকরণ তাতে আরও স্পষ্ট হতো। পুরভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার প্রতিবাদ জানাতে এ দিন ধর্মতলা থেকে কমিশনের দফতর পর্যন্ত মিছিল করে বিজেপি। কমিশনের সামান্য দূরে পুলিশ ব্যারিকেড করে মিছিল আটকালে বসে পড়েন বিজেপি কর্মীরা। ম্যাটাডোরে দাঁড়িয়ে বন্ধের ঘোষণা করেন রাহুলবাবু। আচমকাই রীতেশ তিওয়ারি, অমিতাভ রায়, আনন্দ কিশোর, উমেশ রাই, কমলেশ সিংহ প্রমুখ ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বাধে।