বক্তৃতা কার্শিয়াঙের তৃণমূলনেত্রী শান্তা ছেত্রী ও তপনের বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদার।—নিজস্ব চিত্র।
একুশের সমাবেশে দলনেত্রীর ‘কড়া’ বক্তৃতা শেষ হয়েছে কী হয়নি, মঞ্চ থেকেই শুরু হয়ে গেল জেলা নেতাদের সর্তক করার পালা। কোনও জেলার নেতাদের ডেকে আলাদা করে ধমকে দিলেন মুকুল রায়, কাউকে ডেকে সুব্রত বক্সি জানিয়ে দিলেন ইচ্ছে মতো কমিটি করা যাবে না।
ধর্মতলার মঞ্চে তখন ইন্দ্রনীল-নচিকেতারা গান ধরেছেন। মঞ্চে থাকা উত্তরবঙ্গের এক জেলার যুব সভাপতিকে ডেকে নিলেন রাজ্য স্তরের এক নেতা। সকলের সামনেই সেই নেতাকে বললেন, ‘‘সব কর্মসূচিতে সবাইকে ডাকতে হবে। নেত্রী কিন্তু সবই নজর রাখছেন।’’ কিছু আগেই দলনেত্রী বলেছেন, ‘‘দলে থেকে ইচ্ছে মতো কাজ করলে চলবে না।’’
কোচবিহার থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ থেকে আলিপুরদুয়ার—উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই শাসকদলের গোষ্ঠী সমীকরণ দলকে বারে বারে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিধানসভা ভোটের পরে একুশে জুলাইয়ের সভার প্রস্তুতিতেও রাজ্য নেতারা বিভিন্ন জেলা এসে পইপই করে সকলকে এক সঙ্গে চলার বার্তা দিয়েছেন। তার পরেও অভিযোগ অব্যাহত।
কোচবিহারে এক তৃণমূল কর্মীকে গুলি চালানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হন দলেরই কাউন্সিলর। আলিপুরদুয়ার জেলার বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে জেলা সভাপতির বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ক্ষুব্ধ এক জেলা নেতা মঞ্চে না উঠে ঠায় দর্শকাসনেই বসে থাকেন। তৃণমূলের হাতে থাকা জলপাইগুড়ি পুরসভায় টেন্ডারে ‘সিন্ডিকেট’ চলছে বলে অভিযোগ করেন দলেরই এক কাউন্সিলর তথা জেলা নেতা। গোষ্ঠী সমকীরণের জেরেই বালুরঘাটে চেয়ারপার্সনের মৃত্যুর আট মাস পরেও নতুন কাউকে জেলা নেতৃত্ব মনোনীত করতে পারেনি বলে অভিযোগ। তৃণমূলের রাজ্য নেতার মন্তব্য, ‘‘দলের অন্দরের সব খবরই যে মুখ্যমন্ত্রীর কানে পৌঁছয়, তা এ দিনের বক্তব্যেই পরিষ্কার।’’
কোচবিহারের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামাতে ভোটের আগে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যয়কে জেলায় গিয়ে সভা করতে হয়েছিল। এ দিন মঞ্চে ছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন, বিধায়ক মিহির গোস্বামী, বন উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ, জেলা নেতা আব্দুল জলিল আহমেদ। মন্ত্রী রবিবাবু বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষকে নিয়ে সবাইকে এক সঙ্গে চলতে হবে।’’ অন্য দিকে জলিলবাবুর সাফ কথায়, ‘‘জেলায় দলের মধ্যে নানা সময় একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। গণ্ডগোলের ঘটনাও ঘটছে। এটা ঠিক নয়।”
দলে নতুন-পুরোনো নিয়ে অভিমান গোপন রাখেননি আলিপুরদুয়ারে দলের সহ সভাপতি মৃদুল গোস্বামী। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘পুরোনো কর্মীদের সম্মান না দেওয়ায় অনেকের অভিমান থাকতে পারে। নেত্রী আজকে যা বার্তা দেওয়ার দিয়ে দিয়েছেন।’’ এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি দুই জেলারই সভাপতি। কিছু দিন আগে জেলা বর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে সৌরভ বার বার ডাকলেও মঞ্চে ওঠেননি মৃদুল। একুশের সভার পরে সৌরভবাবু বলেন, ‘‘নেত্রীর যে বার্তা দিয়েছেন তা সকলেই মেনে চলবেন বলে আশা করি। আমরাও কড়া নজর রাখব।” গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিদায়ী মন্ত্রী-দাপুটে নেতাদের বিধানসভা ভোটে হারতে হয়েছে বলে ক্ষোভ রয়েছে কর্মীদের। ওই জেলা নেতাদের নিয়ে এ দিন সুব্রত বক্সি এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায় বৈঠক করেছেন। প্রাক্তন মন্ত্রী শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘ভুল বোঝাবুঝি যা আছে, মিটে যাবে।’’
শিলিগুড়িতে হারের পরে তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়া এবং তাঁর অনুগামীরা দলের কাউন্সিলরদের কয়েকজনের নাম করে দলীয় সভায় অভিযোগ করেছিলেন। জেলায় ভোটে বিপর্যয়ের পরে দলের কমিটি ভেঙে ফের পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্য নেতৃত্ব। নেতা-কর্মীদের ফেরার তদারকি করতে সভার পরে শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়েছিলেন গৌতমবাবু। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘শৃঙ্খলা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে নেত্রী যে আপস করবেন না, তা বক্তৃতাতেই বোঝা গিয়েছে।’’