সমতলের পরে টানা তিন দিন ধরে বৃষ্টির প্রভাব পড়ল উত্তরের পাহাড়েও। শুক্রবার সকাল থেকেই দার্জিলিং, সিকিমে যাতায়াতের কয়েকটি রাস্তায় পাহাড়ের উপর থেকে ঝুরঝুর করে পাথর পড়তে থাকে। বেলা ৯টা নাগাদ ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে কালিম্পঙের পথে ভোটেবীর এলাকায় ধস নামে। পূর্ত দফতরের কর্মীরা গিয়ে ধস সরাতে প্রায় দু’ঘণ্টা গড়িয়ে যায়। বেলা ২টো নাগাদ ফের ধস নামে ওই জাতীয় সড়কের শ্বেতীঝোরায়। ফলে, সিকিমের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ফের বন্ধ হয়ে যায়। পরে ধস সরানো হলে বিকেলের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। দার্জিলিঙের পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেছেন, ‘‘ভোটেবীরের ধস সরানোর পরে শ্বেতীঝোরায় ধস নামায় দু’দফায় সিকিম-কালিম্পঙে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। তবে টানা বৃষ্টিতে ধসের আশঙ্কা বাড়তে থাকায় ধসপ্রবণ এলাকায় বিপর্যয় মোকাবিলা টিম তৈরি রেখেছে জেলা প্রশাসন।’’
লাগাতার বৃষ্টির ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলে উপচে পড়ছে তিস্তা, তোর্সা-সহ একাধিক নদী। তীব্র স্রোতে ফাটল তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সেবক করোনেশন সেতুতেও। ইতিমধ্যে জলের ধাক্কায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে সেবকের রেলসেতুর একটি স্তম্ভ। বৃষ্টি চলতে থাকায় বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে প্রশাসনে। শুক্রবার সকালে সেবক সেতু পরিদর্শন করে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বিধানসভার অধিবেশন ছেড়ে সৌরভবাবু এ দিন সকালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছন। ধসের খবর পেয়ে সিকিমের রাস্তার খোঁজ নেন তিনি।
গত সোম-মঙ্গলবারের টানা বৃষ্টির পরে জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার-কোচবিহারে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বাড়তে শুরু করেছিল নদীর জল। বুধ এবং বৃহস্পতিবার তুলনামূলক কম বৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তবে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টির জেরে একরাতেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করেছে। তিস্তা-তোর্সা-জলঢাকা বিপদসীমা ছুঁয়ে বইছে। বৃষ্টির ধাক্কায় পাহাড় থেকে পাথর খুলে ধস নামতেও শুরু করেছে। এ দিন ভোরে সেবকের পাহাড় থেকেও ঝুরঝুর করে পাথর পড়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। সিকিমেও বৃষ্টি চলতে থাকায় ফের রেল চলাচল বন্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত তিন দিন ধরে ক্রমাগত তিস্তার জলস্রোত ধাক্কা মারছে সেবক রেলসেতুর স্তম্ভে। বড় বোল্ডারও ভেসে যাচ্ছে জলের তোড়ে, করোনেশন সেতুতেও ফাটলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সৌরভবাবু জানিয়েছেন, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহে উত্তরবঙ্গ সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেবকের পরিস্থিতি দেখতে যাবেন। এ দিন রেল দফতররের সঙ্গে কথা বলেছেন সৌরভবাবু। পূর্ত দফতর, জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও এ দিন বৈঠক করেছেন। বর্ষার মরসুমে করোনেশন সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করা কতটা নিরাপদ তাও প্রশাসনের কর্তাদের খতিয়ে দেখার আর্জি জানিয়েছেন এই বিধায়ক। সেবকের পরিস্থিতি দেখে তিনি জলপাইগুড়িতে গিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
আরও পড়ুন: জোট নিয়ে মান্নানের খোঁচা, ধুন্ধুমার বিধানসভায়
গত ২৪ ঘণ্টায় শিলিগুড়িতেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। সেচ দফতরের তরফে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে শিলিগুড়িতে। শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলবন্দি হয়ে পড়েছে। শিলিগুড়ি পুর এলাকার ৩১, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের অশোকনগর, নিউ মিলনপল্লি, সুকান্তপল্লি, শক্তিগড় এলাকায় হাঁটুর উপরে জল জমে যায়। অশোকনগর, নিউ মিলনপল্লি এলাকায় অনেক বাড়িতেও জল ঢুকে পড়ে। রাস্তা জলের তলায় চলে যায় শিলিগুড়ি ইস্টার্ন বাইপাস লাগোয়া ফকদইবাড়ি, মাঝাবাড়ি, ফাড়াবাড়ি এলাকায়। পুর এলাকার শান্তিনগর, সারদাপল্লি, জলপাইমোড় লাগোয়া শীতলাপাড়া, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের রাজীবনগর, সমরনগর, তেলিপাড়া এলাকায় বহু ঘরে জল ঢুকে গিয়েছে।
তিস্তার জল বাড়তে থাকায় ময়নাগুড়ির বাসুসুবা এলাকায় নদীর পাড় ভেঙেছে। মালবাজার এবং ক্রান্তি এলাকায় তিস্তার জল ঢুকতে শুরু করেছে। জলবন্দি হয়ে পড়েছে জলপাইগুড়ির শহরের বিভিন্ন এলাকা। কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারেও প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কোচবিহারে গড়ে ১৫০ আলিপুরদুয়ারে ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে।
এ দিন সৌরভবাবু বলেন, ‘‘সামগ্রিক ভাবে উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো জলবন্দি এলাকাগুলিতে প্রশাসনিক আধিকারিক, এক জন করে জনপ্রতিনিধি উপস্থিত রয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে।’’
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের সিকিমের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘‘সিকিমে দু’দিন ধরেই বৃষ্টি চলছে। সে কারণে সমতলের নদীগুলিতে জল বাড়ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টাতেও ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। বেশ কিছু এলাকা থেকে ধসের খবর মিলেছে, তবে বড়সড় কোনও বিপর্যয় হয়নি। কিন্তু বৃষ্টি চলতে থাকলে বড় ধসের আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে।’’