প্রতীকী ছবি।
জমি আন্দোলনে ভর করেই পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। এবং প্রথম বার শপথ গ্রহণের পরেই সিঙ্গুর আইন গড়ে টাটাদের হাত থেকে জমি ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার পরে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম যে ক’টা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার অন্যতম হল দিঘা জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ। এবং সেই অধিগ্রহণ হবে মমতারই জমি আন্দোলনের এক আঁতুড়ঘর নন্দীগ্রামের খুব কাছে, নন্দকুমার-দিঘা ১১৬বি জাতীয় সড়ককে আড়ে-বহরে বাড়াতে।
যদিও মমতার ঘোষিত অবস্থান ছিল বেসরকারি শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, কিন্তু গত পাঁচ বছরে তৃণমূল রাজত্বে যে কোনও প্রকল্পের জন্যই জমি অধিগ্রহণ কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাটোয়ায় এনটিপিসি-কে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে হচ্ছে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে জমি কিনে। এহেন মুখ্যমন্ত্রী দ্বিতীয় ইনিংসে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ায় প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকেই আশার আলো দেখছেন। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘উন্নয়ন ও পরিকাঠামোর প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী এখন অনেক বেশি উদার। আবেগের তুলনায় প্রশাসক হিসাবে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল।’’ ওই কর্তা জানান, সেই কারণেই ৫০০ কোটি টাকার খরচে ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের সম্প্রসারণের জন্য মুখ্যমন্ত্রী জমি নিতে রাজি হয়েছেন। এর পাশাপাশি রাজ্যে বিভিন্ন জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে এখনও ২৩টি রেলপথ গিয়েছে। সেই বাধা দূর করতে দিল্লির কাছে নবান্নের দাবি ছিল ২৩টি রেলওয়ে ওভারব্রিজের। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক তার মধ্যে ১৯টির অনুমোদন দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ওই ওভারব্রিজগুলির জন্যও জমি নিতে ছাড়পত্র দিয়েছেন বলে প্রশাসন সূত্রে খবর।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে সড়ক উন্নয়নে তিন হাজার কোটির অর্থ সাহায্য করে দিল্লিও রাজ্যকে বার্তা দিতে চেয়েছে বলে নবান্নের একাংশের মত। ফলপ্রকাশের দিন মমতাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিয়েছিলেন সহযোগিতার আশ্বাসও। শপথ অনুষ্ঠানে মোদী পাঠিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে। তিনিও রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে সব রকম সহায়তার কথা বলে যান। জিএসটি পাশ করাতে চেয়ে মমতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন জেটলি। তাতে ইতিবাচক মনোভাবই নিয়েছেন মমতা। গত ১৪ জুন কলকাতায় জিএসটি সংক্রান্ত এমপাওয়ার্ড কমিটির চেয়ারম্যান অমিত মিত্রের নেতৃত্বে সমস্ত রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে জট অনেকটাই কেটেছে বলে বৈঠকের পরে জানিয়ে গিয়েছেন জেটলি নিজেই। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরও ৩০০০ কোটির প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। দিঘা সড়ক সম্প্রসারণ এবং রেল ওভারব্রিজ নিয়ে মমতাও তাই ইতিবাচক মনোভাব নিয়েছেন বলে প্রশাসনিক কর্তারা মনে করছেন।
পূর্ত দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, কোলাঘাট থেকে হলদিয়া পর্যন্ত ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারিত হয়েছে। কোলাঘাট-খড়্গপুর ছয় নম্বর জাতীয় সড়ক এবং ওড়িশাগামী ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডও এখন বেশ চওড়া। কিন্তু নন্দকুমার মোড় থেকে দিঘা পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়কের হাল বেশ খারাপ। আদতে দু’লেনের হলেও জবরদখলের জন্য বহু স্থানে সড়কটি ৭ মিটারও চওড়া নয়। ফলে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। পূর্ত দফতর সড়কের প্রস্থ বাড়িয়ে ১৪ মিটার, অর্থাৎ ৪ লেন করতে চায়। কোনও কারণে সেটা করা না-গেলে অন্তত ৩ লেনের সড়ক, অর্থাৎ সাড়ে দশ মিটার চওড়া করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রাস্তা চওড়া হলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দিঘার আকর্ষণ আরও বাড়বে। তা ছাড়া গোপালপুর সৈকত শহর থেকে দিঘা পর্যন্ত একটি নতুন জাতীয় সড়কের প্রস্তাব করেছে ওড়িশা। সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক ৫০০ কিমি দীর্ঘ এই প্রকল্পে ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিন কয়েক আগে উপকূলীয় রাজ্যের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নীতিন গডকড়ি জানান, গোপালপুর-দিঘা এবং দিঘা-নন্দকুমার জাতীয় সড়ক নির্মাণ হয়ে গেলে পূর্ব উপকূলে একটি নতুন বাণিজ্যপথ তৈরি হয়ে যাবে।
সেই বাণিজ্যপথের সুবিধা নিতেই দিঘা পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করতে নামছে জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। পূর্ত দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, জাতীয় সড়ক উন্নয়নের আইনেই জমি অধিগ্রহণের নোটিস দেওয়া হবে। তাতে জমিদাতারা অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ পাবেন। জেলা প্রশাসন সেই জমি নেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করবে।
জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূর্বাঞ্চলের কর্তা আশুতোষ গৌতমের কথায়, ‘‘সড়ক উন্নয়নের কাজে সরকার সহায়তা করছে। আশা করছি, জমিও পাওয়া যাবে।’’ এক কর্তা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে বকেয়া প্রকল্পগুলিতে জমি নেওয়ার জন্য জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৬০০ কোটির বেশি খরচ করেছে। প্রয়োজনে আরও খরচ করা হবে। জমিদাতাদের বোঝাতে রাজনৈতিক প্রচারও চলবে। নন্দীগ্রামের জেলায় ২০০৭ সালের পর থেকে আর কোনও জমি অধিগ্রহণ হয়নি। রাস্তার জমি কি সহজে মিলবে? শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার কথায়, ‘‘জমি নিতে সমস্যা হবে না। দিঘার রাস্তা চওড়া হলে মানুষেরই লাভ। হলদিয়ার রাস্তা সম্প্রসারণের লাভ জেলাবাসী পেয়েছে। মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ পেলে মানুষ নিশ্চয় জমি দেবে। তবে জোর করে নয়, বুঝিয়ে জমি নেওয়া হবে।’’