কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বাজি বিস্ফোরণে মৃতের পরিজন। বুধবার এগরার খাদিকুল গ্রামে। ছবি: শুভেন্দু কামিলা।
কেউ জব কার্ড থাকা সত্ত্বেও পাননি একশো দিনের কাজ। কেউ আবার বার বার আবেদন করার পরেও জব কার্ডটাই পাননি। এমনই লোকজনের সামনে সম্ভবত কাজের ‘সুযোগ’ করে দিয়েছিল বাজি কারখানা। স্থানীয়দের দাবি, সেখানে কম সময় কাজ করে বেশি টাকা পাওয়ার সুযোগ ছিল। জানা গিয়েছে, এই কাজের জন্য লোক জোগাড়ে অর্থের টোপও দেওয়া হত।
কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানুর বেআইনি বাজি কারখানায় ১৯৯৫ সালে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। সে বার পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০১ সালে ফের বিস্ফোরণ কেড়ে নেয় ভানুর নিজের ভাই-সহ তিন জনের প্রাণ। বার বার প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ সত্ত্বেও ভানু এই কারবার চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকের জোগান কোথা থেকে পেতেন তিনি?
স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, গ্রামের গরিব লোকজনকে কখনও হুমকি দিয়ে, কখনও বা সাহায্যের নামে ঋণের জালে বেঁধে বাজি তৈরিতে বাধ্য করতেন ভানু। অনেকে আবার মাত্র ঘণ্টা তিনেকের কাজে ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির লোভেও আসতেন। মঙ্গলবার বিস্ফোরণে মৃত শ্যামশ্রী মাইতির ছেলে কৌশিক এগরার সারদা শশীভূষণ কলেজে স্নাতকস্তরে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘‘বাবা দিনমজুরি করেন। আমার পড়ার খরচ জোগাড়েই মা কয়েক মাস ধরে বাজি কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন।’’ কৌশিকের দাবি, ‘‘মায়ের একশো দিনের জব কার্ড ছিল। তবে কোনও দিন কাজ পাননি।’’ বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন জয়ন্ত জানা। তাঁর ভাইপো মানিক জানাও বলেন, ‘‘কাকা কবে একশো দিনের কাজ করেছেন, মনে পড়ছে না!’’ বিস্ফোরণে মৃত মাধবী বাগের স্বামী সঞ্জীবের বক্তব্য, ‘‘স্ত্রীর জব কার্ডই ছিল না। কত আবেদন করেছি। লাভ হয়নি।’’
একশো দিনের কাজ না থাকা ও মজুরি বকেয়া থাকা যে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধাক্কা দিচ্ছে, তা মানছেন সকলেই। এগরা-১ ব্লক প্রশাসন ও সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২১-২২ আর্থিক বছরে উপকরণ কেনা বাবদ ৫২ লক্ষ ৪ হাজার টাকা ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা বকেয়া আছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে বকেয়ার পরিমাণ ২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে তৃণমূল পরিচালিত সাহাড়া পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছে নির্দল-সহ বিরোধীরা। প্রধান নির্দল হিসেবে জয়ী স্বপন দণ্ডপাট অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি। তবে, প্রাক্তন প্রধান তৃণমূলের শান্তিলতা দাসের দাবি, ‘‘জব কার্ডধারীরা সকলেই কাজ পেয়েছেন। কেন্দ্রের টাকা যত দিন পাওয়া গিয়েছে, কাজ দেওয়া হয়েছে।’’ তবে এগরা ১-এর বিডিও সুমন ঘোষ মানছেন, ‘‘গত দেড় বছরে গোটা ব্লকে একশো দিনের কাজ বন্ধ রয়েছে।’’
এ নিয়ে চলছে রাজনৈতিক চাপানউতোরও। বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক মমতা মাইতির অভিযোগ, ‘‘ভুয়ো মাস্টার রোল বানিয়ে পঞ্চায়েতগুলিতে টাকা লুট করেছে তৃণমূল। তাই কেন্দ্র বাধ্য হয়েছে টাকা আটকাতে। সে জন্যই গ্রামের গরিব লোকেদের দুর্বিষহ অবস্থা।’’ স্থানীয় বিধায়ক তথা কাঁথি সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল সভাপতি তরুণ মাইতির পাল্টা দাবি, ‘‘গত বিধানসভা ভোটে জিততে না পেরে বিজেপি রাজ্যের মানুষকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে। তাই একশো দিনের কাজে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করেছে কেন্দ্র।’’ তবে তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘রাজ্যের একার পক্ষে এই প্রকল্প চালানো সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই হয়তো লোকে বিকল্প রুজির খোঁজে জীবনের ঝুঁকিও নিচ্ছেন।’’