কুড়মিদের ক্ষোভ প্রশমনে শুভেন্দুকেই আবার দায়িত্ব দিল বিজেপি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রথমে ছিল তৃণমূলের ‘শক্ত ঘাঁটি’ দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে চ্যালেঞ্জ জানাতে তাঁকেই এগিয়ে দিয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। এ বার কুড়মি ক্ষোভ সামাল দিতেও আসরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেই নামাতে চলেছেন বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সূত্রের খবর, এই বিষয়টি দেখতে নন্দীগ্রামের বিধায়কের কাছে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা এসেছে।
কেন্দ্রীয় বিজেপির সহ-সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষের সঙ্গে কুড়মি নেতাদের বিবাদ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বুধবার দিলীপের বাড়ির গেট ভেঙে ঢুকে পড়েছিলেন বিক্ষোভকারী কুড়মি সমাজের লোকজন। বলা বাহুল্য, দিলীপের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কুড়মিদের নিজেদের দিকে টানতে উদ্যোগী হয়েছেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবারেই নবান্নে পূর্বাঞ্চলীয় কুড়মি সমাজের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন তিনি। তাদের যাবতীয় দাবিদাওয়া খতিয়ে দেখার আশ্বাসও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখছেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ। তাঁদের আশঙ্কা, দিলীপের প্রতি ক্ষোভের জেরেই জঙ্গলমহলের কুড়মি সমাজের একটি বড় অংশ বিরূপ হতে পারে বিজেপির উপর। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট তো বটেই, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও। তাই সেই সমস্যা সমাধানে দ্রুত বিরোধী দলনেতাকে সামনে এগিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
রাজ্য বিজেপির অন্দরে সকলেই জানেন, দিলীপ-শুভেন্দু সম্পর্ক ‘শীতল’। প্রকাশ্যে তাঁদের কারওরই আচরণে তেমন কিছু দেখা যায়নি। তবে কখনও-সখনও দিলীপের কিছু বিক্ষিপ্ত মন্তব্যে দুই নেতার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে জল্পনার অবকাশ তৈরি করেছে। ঘটনাচক্রে, এখন দিলীপকে নিয়ে যে সমস্যার সূত্রপাত, তার সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হল শুভেন্দুকে। যা থেকে দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে আবার জল্পনার পরিসর তৈরি হতে পারে। এমনও আলোচনা শুরু হতে পারে যে, দিলীপের চেয়ে শুভেন্দুকে বেশি ‘আস্থাভাজন’ মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
তবে বিজেপির একাংশের বক্তব্য, তৃণমূলে থাকাকালীন জঙ্গলমহলের সবক’টি জেলার দীর্ঘ দিন পর্যবেক্ষক ছিলেন শুভেন্দু। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা মনে করেন, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলির রাজনৈতিক সমীকরণ তাঁর দখলে রয়েছে। সেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই লোকসভা ভোটের আগে জঙ্গলমহলের কুড়মি সমাজের সমর্থন ফিরে পাওয়া বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের লক্ষ্য।
প্রসঙ্গত, বুধবারেই বাঁকুড়ার সিমলাপালের সভায় যাওয়ার পথে শুভেন্দু তাঁর কনভয় থামিয়ে আন্দোলনরত কুড়মি সমাজের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কুড়মিদের স্লোগানও দিয়েছে। সেখানে দিলীপ তাঁর বক্তব্য এবং অবস্থান নিয়ে ‘অনড়’ মনোভাব বজায় রেখেছেন।
গত রবিবার ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় থানার বামাল গ্রামে দলীয় কর্মসূচিতে যাওয়ার সময় কুড়মিদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ। তাঁর কাছে কুড়মি সমাজের নেতারা জানতে চান, সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদলের নেতা হিসেবে তিনি কুড়মিদের জন্য কী করেছেন? দিলীপ জানান, খেমাশুলিতে আন্দোলনের সময় তিনি কুড়মি নেতাদের নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। আন্দোলনকারীদের সাহায্যার্থে চাল-ডালও পাঠিয়েছিলেন তিনি। দিলীপের এমন মন্তব্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় কুড়মি সমাজে। তার প্রেক্ষিতে সোমবার দিলীপ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেন, ‘‘ওরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে সব ক’টা নেতার কাপড় খুলে দেব! দিলীপ ঘোষের পিছনে যেন লাগতে না আসে!’’
এতে কুড়মিদের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে। রানিবাঁধে দিলীপের কুশপুতুল পোড়ানো হয়। কুড়মিরা হুঁশিয়ারি দেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চেয়ে দিলীপ নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার না করলে বুধবার ৫০ হাজার কুড়মিকে নিয়ে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করা হবে। সেই মতো বুধবার দিলীপের বাড়ির সামনে জমায়েত করেন কুড়মিরা। অভিযোগ, দিলীপের বাংলোর বাইরের লোহার গেটটি লাথি মেরে খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। সেখানে গিয়ে জামা খুলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলে। এই সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি রিপোর্টও জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে। দলগত ভাবেও বিষয়টির উপরে নজর ছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।
সূত্রের দাবি, ঘটনাক্রম নিয়ে দিলীপের ভূমিকায় একেবারেই ‘সন্তুষ্ট’ নন বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, দিলীপ প্রকাশ্যে কুড়মিদের প্রতি তাঁর ক্ষোভের কথা বলে পরিস্থিতি আরও ‘জটিল’ করে তুলেছেন। তার পরেই পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিরোধী দলনেতাকে কুড়মিদের ক্ষোভ প্রশমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই কুড়মি সমাজের সমর্থন রয়েছে বিজেপির দিকে। তাদের ভোটে জঙ্গলমহলের লোকসভা আসন দখল করতে সফল হয়েছে বিজেপি। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তা দেখা যায়নি। সেইজন্যই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই ফিরিয়ে আনতে মরিয়া বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাই শীর্ষনেতৃত্ব কোনও ভাবেই চান না, দিলীপের কথায় কুড়মিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ুক। কারণ, দিলীপ বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। তাঁর বক্তব্যে কুড়মি সমাজের কাছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে ‘ভুল’ বার্তা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা পেয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন শুভেন্দু। বুধবার বাঁকুড়ার সিমলাপালে জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে হরিণটুলি গ্রামে রাস্তার ধারে কুড়মিদের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে যায় তাঁর কনভয়। এর পরে গাড়ি থেকে নেমে মিনিট দশেক কুড়মি নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধী দলনেতা। কুড়মিদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘জয় গরাম’ স্লোগানও দেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, এর পরে প্রয়োজন অনুযায়ী আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন বিরোধী দলনেতা। তবে সেই পদক্ষেপ কী হবে, তা খোলসা করেননি তিনি।