রবীন্দ্র সরোবর: সকাল ৭টা
খবর্দার, গলায় কিছু পরিস না
সল্টলেক। বনবিতানের গেটের বাইরে বেসরকারি রক্ষী। ভিআইপি প্রার্তভ্রমণকারী, রাজ্য পুলিশের এডিজি (প্রশাসন) রাকেশকুমার গুপ্ত ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রাক্তন যুগ্ম সচিব নাসিরুদ্দিন সাহেবও গটগটিয়ে হাঁটছেন। এই পরিবেশে হাঁটতে সাধারণ নাগরিকদের আলাদা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু বাইরের ছবিটা অন্য রকম।
সকাল ছ’টায় খালপাড়ের নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে থমকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন এ ই ব্লকের যমুনা শিট। পরিচয় হতে বললেন, ‘‘গলায় হার পরার সাহস নেই! পাতলা সোনার দুল পরে বেরোলেও বুকটা দুরু দুরু করে। মোটরবাইক গেলে তো বটেই, পাশ দিয়ে সাইকেল গেলেও খানিকটা থমকাতেই হয়।”একই অবস্থা তাঁর প্রতিবেশী দিতি চক্রবর্তীরও।
এ এ ব্লকের পিছনে বৈশাখী পর্যন্ত এই রাস্তা ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’-এর সামনে দিয়ে গিয়েছে। সল্টলেকের বাসিন্দারা ছাড়াও লেকটাউন, বাঙুর এবং বেলগাছিয়ার লোকেরা সকাল থেকে ফুটব্রিজ পেরিয়ে ঢুকতে শুরু করেন। অনেকেরই বক্তব্য, পুলিশ কিন্তু কালে-ভদ্রেই চোখে পড়ে।
দু’বছর আগে এ ই ব্লকের এক বৃদ্ধার হাতের বালা খুলে নিয়ে গিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। এর পরে বাসিন্দারা সচেতন হলেও গা ছমছমে ভাব এখনও কাটেনি। এক প্রৌঢ়ার কথায়, “আমার মেয়ে, বৌমাদের হাঁটতে বেরোনোর সময়ে পই-পই করে বলি, খবর্দার, গলায় কিছু পরিস না! আর পরলে বরং এখনও শাল-টাল কিছু জড়িয়ে নিয়ে বেরো!”
বারণ করেন রক্ষীরাই
রবীন্দ্র সরোবর, গল্ফগ্রিন। সময়টা যে সুবিধের নয়, তা মানছেন টালিগঞ্জ থানার দুই পুলিশকর্মীই। লেকের ধারে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের চায়ের ঠেকে তৃপ্ত চুমুকের ফাঁকে দুশ্চিন্তা লুকোতে পারছেন কই! শীতে কম লোক রাস্তায় বেরোয়। কুয়াশা বেশি হলে দুষ্কর্মের সম্ভাবনাও বাড়ে ঠিকই। কিন্তু পুলিশের মতে, গরমেই ছিনতাইবাজদের সুবিধে। এক পুলিশকর্মীর কথায়, “আমরা তো টহল চালাচ্ছিই! কিছু ঘটছে না, ঠিকই আছে! ঘটলে কিন্তু ওপরতলার কর্তাদের তোপের মুখে শান্তিতে চা খাওয়াই মাথায় উঠবে।”
ওই পুলিশকর্মীদের জন্য সুখবর: লেকে সকালবেলার চেনা মুখ, কৃষ্ণা পাত্র, মুক্তি মাইতি, ডলি বসু, মঞ্জু ভট্টাচার্য, রুমা দত্তেরা এখনও সাত-সকালে দুল-হার না পরে আসার অভ্যেসটাই বজায় রেখেছেন। হাল্কা আসন করার ফাঁকে ওঁরা বলছিলেন, লেকের নিরাপত্তারাক্ষীরাই তো বারণ করেন, গয়না পরে আসতে! চারু মার্কেটের বাসিন্দা রীতা বাগ আবার জানালেন, পুলিশ সেজে তাঁর পরিচিত এক জনের কাছ থেকেই গয়নাগাঁটি ছিনতাই করা হয়েছে সম্প্রতি।
গল্ফগ্রিনের সেন্ট্রাল পার্কে বিজয়গড়ের চণ্ডীরানি দে বা যাদবপুরের রেখা বন্দ্যোপাধ্যায়রাও হাঁটতে আসার আগে গলার হার খুলেই বেরোন। রেখাদেবী বললেন, “এলাকাটা এমনিতে নিরাপদ। অল্পবয়সী মেয়েরাও তো হাঁটতে আসে। কখনও কোনও অশালীন আচরণের ঘটনা ঘটে না। তবে সোনার গয়নাটা পরে আসার ভরসা হয়
না। বেরোনোর আগে তাই ও-সব খুলেই আসি।”
বনবিতান: সকাল ৬টা
টালা পার্ক: সকাল সওয়া ৬টা
ভরসা রামঅবতার
টালা পার্ক। ননদ সুমন ও মেয়ে সুমিতাকে নিয়ে পূজাদেবী গাড়ি থেকে নামার সময়েও ভাল করে আলো ফোটেনি। টালার জিমখানা মাঠে ঢুকে তাঁদের হাঁটাহাঁটি শুরু হলে রক্ষীর ভূমিকায় নজরদারি শুরু করলেন চালক রামঅবতার। বললেন, দাদা-বৌদিরা আমায় ভাইয়ের মতো দেখেন। এমনি জায়গাটায় ঝুটঝামেলা না-থাকলেও দাদা বলে দিয়েছেন, সারা ক্ষণ ওঁদের কাছাকাছি থাকতে।
জসবিন্দর কউর বা মীনা দাস, শর্মিষ্ঠা দাসেরা অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নন। শর্মিষ্ঠার মেয়ে ক্লাস থ্রি-র অদিতিও সঙ্গে রয়েছে। সকালের ছিমছাম সাজে কেউ কেউ টুকিটাকি সোনাও পরেছেন। ওয়াকম্যানে কৈলাস খের শুনতে শুনতে শর্মিষ্ঠা বললেন, কিছু দিন আগে রাজা মণীন্দ্র রোডে একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও এক বার পার্কে ঢুকে গেলে দিব্যি ফুরফুরে লাগে। তবে অনেকেই চেষ্টা করেন, দিনের আলো ভালো করে ফোটার পরে ছ’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোতে।
কিছু নতুন বাসিন্দা, এখনও এলাকার ঘাঁতঘোঁত ততটা ভাল ভাবে চেনেন না। তাঁরা উটকো লুটেরার টার্গেট হতে পারেন ভেবে খানিকটা শশব্যস্ত পুলিশ। পুলিশ নিয়মিত টহলদারির কথা বললেও ওই তল্লাটে কিয়স্কের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কিয়স্ক এবং তার ভিতরে পুলিশ থাকলে আর একটু নির্ভাবনায় ঘোরা যেত মনে করেন অনেক বাসিন্দাই।
দাওয়াই পাড়াতুতো জোট
দেশবন্ধু পার্ক। প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় ছ’টার আগে প্রায়ই হাল্কা গা ঘামান। পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকেও মাঝেমধ্যে দেখা যায় টেনিসের আসরে। দেশবন্ধু পার্কের ভিতরটায় তাই খানিকটা স্বস্তির হাওয়া।
সাহিত্য পরিষৎ স্ট্রিটের মিতালি নিয়োগী, মদনমোহনতলার অনুভা সাহা বা শ্যামবাজারের শিবানী চন্দরা সেটাই বলছিলেন। চোখে পড়ল, বাইরে কিয়স্কে সকাল সাড়ে সাতটাতেও পুলিশকর্মীর উপস্থিতির দুর্লভ দৃশ্য। নিরাপদ ভ্রমণের জন্য সব থেকে জরুরি কি পুলিশি তৎপরতাই? উত্তর কলকাতার ভূমিপুত্র দেশবন্ধু পার্কের প্রবীণদের আড্ডা ‘ইউজলেস ক্লাব’-এর মাথা অলোক মুখোপাধ্যায়, মহুয়া সেনগুপ্ত, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়েরা অবশ্য অন্য তত্ত্ব দিলেন। সাত-সকালেই হাঁটাহাঁটি সেরে ফুটপাথে টুল পেতে নরক গুলজার! অলোকবাবু বলছিলেন, “এখানে সবাই সবাইকে চিনি!
পাড়ার লোক। পাড়াতুতো এই জোটটা আছে বলেই এখানে এসে বাইরের লোক কুকাজ করার সাহস পাবে না।” পুলিশও মাঝেমধ্যেই এটা স্বীকার করে!
কলকাতার পুরনো পাড়াগুলো ভেঙে যাওয়ার জমানায় এই দাওয়াই অবশ্য সর্বত্র খাটে না।
(প্রতিবেদন: ঋজু বসু, সোমনাথ চক্রবর্তী ও সাবেরী প্রামাণিক। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী, শৌভিক দে ও স্বাতী চক্রবর্তী)