স্কুলবাস থেকে পড়ে ছাত্রের মৃত্যু সল্টলেকে

সল্টলেকের জিডি আইল্যন্ডের মোড়। এক দিকে একটি চক্ষু হাসপাতাল, অন্য দিকে রাস্তার দু’ধারে রাষ্ট্রীয় হোমিওপ্যাথি হাসপাতাল ও একটি বেসরকারি হাসপাতাল। কাছেই একটি বেসরকারি স্কুল। লাবণি আইল্যান্ডের দিক থেকে এসে এই রাস্তা ধরেই রোজ দুপুরে ছাত্রদের নামাতে নামাতে যায় স্কুলবাস। আইল্যান্ডের সামনেই নামত ইন্দ্রজিৎ। শুক্রবারও তাই নামছিল। আচমকাই পা ফস্কে যায়। পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত ওই ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৩
Share:

শোকে বিহ্বল ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডুর বাবা। ছবি: শৌভিক দে।

সল্টলেকের জিডি আইল্যন্ডের মোড়। এক দিকে একটি চক্ষু হাসপাতাল, অন্য দিকে রাস্তার দু’ধারে রাষ্ট্রীয় হোমিওপ্যাথি হাসপাতাল ও একটি বেসরকারি হাসপাতাল। কাছেই একটি বেসরকারি স্কুল। লাবণি আইল্যান্ডের দিক থেকে এসে এই রাস্তা ধরেই রোজ দুপুরে ছাত্রদের নামাতে নামাতে যায় স্কুলবাস। আইল্যান্ডের সামনেই নামত ইন্দ্রজিৎ। শুক্রবারও তাই নামছিল। আচমকাই পা ফস্কে যায়। পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত ওই ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

Advertisement

পুলিশ জানায়, স্কুলবাস থেকে পড়ে গিয়ে জখম হয়েই মৃত্যু হয় অ্যাসেম্বলি অব গর্ড চার্চ স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডুর (১৬)। ময়না-তদন্তের পরেই মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই ছাত্রের মাথার পিছনে গুরুতর আঘাত ছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। নাক ও মুখ থেকে প্রভূত পরিমাণে রক্ত বেরিয়েছে। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও চিকিৎসায় সে সাড়া দেয়নি।

ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু

Advertisement

প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের দাবি, খালাসি ও চালকের গাফিলতিতে স্কুলবাসের চাকায় পিষ্ট হয়েই মৃত্যু হয়েছে ওই ছাত্রের। রাত পর্যন্ত অবশ্য এই ঘটনায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি বলে জানায় পুলিশ। তবে বাসের খালাসি ও চালকের গাফিলতি কার্যত স্বীকার করেছেন একাংশ। বাস-সহ চালককে আটক করা হয়েছে। খালাসি পলাতক।

এক প্রত্যক্ষদর্শী ভোলানাথ দাস জানান, এ দিন দুপুর পৌনে দুটো নাগাদ স্কুলবাসটি রাস্তার প্রায় মাঝে এসে স্পিড কমিয়ে দেয়। চলন্ত অবস্থায় ইন্দ্রজিৎ বাস থেকে নামতে গিয়ে পিছলে যায়। বাঁ পা উপরে উঠে গিয়ে পিছন দিকে বাসের তলায় পড়ে যায় সে। ভোলানাথবাবুর অভিযোগ, খালাসি সে দিকে খেয়াল না করেই বাসে চাপড় মারতে থাকে। বাসটাও চলতে শুরু করে। ইন্দ্রজিতের ঘাড় ও মাথার ছুঁয়েই বাসটির পিছনের দুটি চাকা চলে যায়।

ওই অবস্থায় স্থানীয় দোকানি থেকে পথচলতি মানুষ চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু তাতে ফল হয় উল্টো। প্রচণ্ড গতিতে বাসটিকে আইল্যন্ড থেকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দেন চালক। বাসে তখন আরও তিন জন ছাত্র। ওই অবস্থায় স্থানীয় কয়েক জন রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত ইন্দ্রজিৎকে তুলে নিয়ে আইল্যন্ডের উল্টো দিকের হাসপাতালে নিয়ে যান। আরও কয়েক জন বাসটিকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকেন। অভিযোগ, বাস থামাননি চালক।

স্থানীয় বাসিন্দারা যখন বাসটির পিছু ধাওয়া করছেন তখন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড় পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়িচালক সনাতন সর্দার। প্রায় ৫০০ মিটার পিছু ধাওয়ার পরে ওই বাসটিকে থামান তিনি। বাস থেকে পালায় খালাসি। পরে বাসটিকে সল্টলেক দক্ষিণ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই বাসে থাকা তিন ছাত্রকে বাড়ি ফেরায় পুলিশ। ঘটনাস্থলে যান সল্টলেক দক্ষিণ থানার আইসি সুরজিৎ দে, সল্টলেক পুর-চেয়ারম্যান পারিষদ তথা কাউন্সিলর দেবাশিস জানা।

ওই আইল্যান্ডের কাছে পুলিশ আবাসনে ইন্দ্রজিতের বাড়ি। বাবা কলকাতা পুলিশের এএসআই শ্যামসুন্দর কুণ্ডু। বর্তমানে ডেপুটেশনে যিনি বিমানবন্দরে দায়িত্বরত। মা লীলা কুণ্ডু গৃহবধূ। এ দিন দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি হয় ইন্দ্রজিৎ। খবর পেয়ে ছুটে যান মা লীলাদেবী। সেখানেই দুপুর ৩৫ মিনিটে মৃত্যু হয় ইন্দ্রজিতের। পাড়ায় জনপ্রিয় ‘তোতন’-এর দুর্ঘটনার খবরে গোটা পাড়ার লোক পৌঁছে যান হাসপাতালের সামনে। ইন্দ্রজিতের অবস্থা সম্পর্কে জানতে দীর্ঘ ক্ষণ ভিড় করেন পথচলতি মানুষও।

এ দিন দুপুরেই ছেলের স্কুলের বেতন দিতে গিয়েছিলেন শ্যামসুন্দরবাবু। সেখান থেকে বেরিয়ে শিয়ালদহে বাজার করছিলেন। সেখানেই পুলিশের ফোন পেয়ে দ্রুত হাজির হন হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

এ দিন মৃত্যুর খবর পেয়ে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি প্রতিবেশীরা। তাঁদের প্রশ্ন, কেন এই স্কুলবাসগুলি নিয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ করা যাচ্ছে না? আর কত প্রাণের বিনিময়ে টনক নড়বে স্কুল, প্রশাসন কিংবা স্কুলবাস মালিকদের, প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।

ইন্দ্রজিতের বাবা শ্যামসুন্দরবাবু বলেন, “প্রাইমারি থেকেই একটি বেসরকারি সংস্থার বাসে স্কুলে যাতায়াত করত ছেলে। শুনছি বাসের তলায় পড়ে গিয়েছিল। পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে। তারাই তদন্ত করে দেখবে।”

কী বলছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ? হাসপাতালে দাঁড়িয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ ভিক্টর সিংহ বলেন, “আমার এক ছেলে চলে গেল। মেধাবী, কবিতা, গান সহ নানা বিষয়ে পারদর্শী এমন একটি ছাত্রের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।” তিনি জানান, স্কুলের নিজস্ব স্বল্পসংখ্যক বাস রয়েছে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ যে ট্রাভেলসের বাসে যেত, তাঁর সঙ্গে স্কুলের কোনও যোগ নেই। নিয়ম মতো ছাত্র রাস্তায় নামা পর্যন্ত সিঁড়িতে দাঁড়ানোর কথা খালাসির। ছাত্র নেমে যাওয়ার পরে খালাসি সঙ্কেত দিলে তবেই বাস ছাড়ার কথা। এ দিন তা কেন মানা হয়নি, তার কৈফিয়ত চাইবেন বলে জানিয়েছেন ভিক্টর। তাঁর অভিযোগ, “খবর পেয়ে ট্রাভেলসের মালিক জ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। ওঁকে ডেকে তদন্ত করুক পুলিশ।” জ্যোতিবাবুকে বার বার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

কিন্তু চালক, খালাসিদের গাফিলতির পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা, লাগামছাড়া পার্কিং এবং ফুটপাথ জুড়ে দোকান নিয়ে। যে কারণে রাস্তার মাঝেই বাস থামান চালকেরা। পথচারীরাও রাস্তার মাঝখান দিয়েই চলাচল করেন। অভিযোগ, এ দিনও যে রাস্তা ধরে বাসটি আসছিল, সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের পাশাপাশি ফুটপাথ ঘেঁষে নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ ছিল। তাই ফুটপাথে নামার বদলে ইন্দ্রজিৎ রাস্তার মাঝখানে নামে।

পুলিশ অবশ্য ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছে। সল্টলেকের এক পুলিশকর্তা জানান, ওই হাসপাতাল মোড়ে গাড়ি বেড়েছে। সেখানে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন-সহ যান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাসিন্দাদের কথা কার্যত সমর্থন করে পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ দেবাশিস জানাও বলেন, “অতি দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে।”

বাইরে যখন এত কাণ্ড চলছে, হাসপাতালের একটি ঘরে বসা লীলাদেবী তখনও ছেলের মৃত্যুর খবর পাননি। সন্ধ্যায় তাঁকে জানানো হয়। এ দিন হাসপাতালের বাইরে শ্যামসুন্দরবাবু ফোনে তাঁর দাদাকে বলেন, “বড়দা, তোতনকে রক্ষা করতে পারলাম না। ক্ষমা করিস।” প্রতিবেশীরা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

পুলিশ আবাসনের এন-৮ নম্বর বাড়ির দোতলায় তোতনের ঘরের দেওয়াল জুড়ে তার নিজের হাতে আঁকা নানা রকম গাড়ির ছবি। মা লীলাদেবী জানান, বিভিন্ন গাড়ি সম্পর্কে দারুণ আগ্রহ ছিল তোতনের। শ্যামসুন্দরবাবু জানান, কম্পিউটর নিয়েও মেতে থাকত ইন্দ্রজিৎ। পড়াশোনায় মেধাবী, গান-কবিতা-ছবি আঁকাতেও সমান পারদর্শী। স্কুল ডায়েরির প্রথম পাতায় সেই ইন্দ্রজিতের আঁকা ছবি সে সাক্ষ্যই বহন করছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement