কোথাও প্রকল্প ব্যয়ের তিন শতাংশ, কোথাও বা সাত। রেল বাজেটে কলকাতার মেট্রো প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ এ রকমই। মেট্রোর অনেক কর্তার কথায়, এ বার বাজেটে চালু প্রকল্পগুলির ভাঁড়ে কার্যত মা ভবানী।
গত বছর বাজেটে এই সব প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ৫৪০ কোটি টাকা। এ বার তা হল ৫৮০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পগুলি শেষ করতে এখনও প্রয়োজন ১০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এ বাজেটে বরাদ্দ মোট প্রকল্প-ব্যয়ের কার্যত পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। তবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের বরাদ্দকে এই বাজেটের বাইরে রাখা হয়ে থাকে বলে রেল সূত্রের বক্তব্য।
ইস্ট-ওয়েস্ট প্রকল্পকে বাদ দিলে অন্য প্রকল্পগুলির পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাজেটের পরে বৃহস্পতিবারও তৃণমূলের অন্দরে মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমানো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, এই বাজেট বাংলা বিরোধী। রেলমন্ত্রীর বাজেট ভাষণের পরে ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রীর টিপ্পনি: ‘বাজেটে মেট্রো ভো-কাট্টা’।
রেলকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, বাজেটে কলকাতার মেট্রো প্রকল্পগুলির জন্য যা টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা খুব একটা কম নয়। জমি-জটে আটকে রয়েছে একের পর এক মেট্রো প্রকল্পর কাজ। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্য সরকার জমি সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছে না বলেই কাজ এগোচ্ছে না।
বাজেটে বরাদ্দ করা টাকা ফিরিয়ে দিতে হয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে। মেট্রোকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৩-১৪ সালে মেট্রো-প্রকল্পের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করেছিল রেলমন্ত্রক, সেই টাকা খরচ করা যায়নি। ওই টাকা ফেরত গিয়েছে। আর সেই কারণেই অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে বলে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে রেলমন্ত্রক।
রাজনৈতিক চাপান-উতোর চললেও এ বার প্রকল্পগুলিতে ঠিক কেমন বরাদ্দ হয়েছে বাজেটে? নোয়াপাড়া-বিমানবন্দরের ভাগ্যে জুটেছে মোট প্রকল্প ব্যয়ের সাত শতাংশ। বরাহনগর-ব্যারাকপুর-দক্ষিণেশ্বর রুটের হাল আরও খারাপ। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ব্যয়ের মাত্র চার শতাংশ। বিমানবন্দর-নিউ গড়িয়ার ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে সাত শতাংশ টাকা। সব চাইতে খারাপ অবস্থা জোকা-বি বা দী বাগ প্রকল্পের। এই প্রকল্পের কপালে জুটেছে মোট ব্যয়ের মাত্র তিন শতাংশ।
তবে বাজেটে এই বরাদ্দের কথা বলা হলেও টাকা দেওয়ার আগে অগস্ট মাসে আর এক বার কাজের গতি খতিয়ে দেখা হবে। অগ্রগতি দেখানো গেলে তবেই টাকা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন রেলের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর। তিনি বলেন, “আরভিএনএল ওই কাজগুলি শুরু করে অগ্রগতি দেখাতে পারলে নিশ্চই নতুন করে ভাববে রেলবোর্ড।”
কিন্তু মেট্রো-প্রকল্পের এই হালের জন্য দায়ী কে? রেল সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক আক্রমণ ও সমালোচনা যে হবে, তা রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর অজানা ছিল না। তাই রেল বাজেট বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, রেলমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন এই দায় তাঁর একার নয়। চাইলেই টাকা পাওয়া যাবে, এমন গৌরী সেনের অবস্থা আর রেলের নেই। বাজার থেকে টাকা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তাতে সরকার সফল হলে তবেই কাজ এগোবে।
কিন্তু রেলের হাঁড়ির খবর কি জানতেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রকের ওই আমলা। বাংলার জন্য কিছু করার আবেগের তাড়নায় হোক বা ভোটের অঙ্ক হিসাব করেই, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কল্পতরু হয়েছিলেন মমতা। কিন্তু পরে দীনেশ ত্রিবেদী বা মুকুল রায়ের মতো তাঁর উত্তরসূরীরাও এসে দেখেছেন, দ্রুত এত টাকার জোগান দেওয়া রেলের পক্ষে অসম্ভব।
এই কারণেই গোটা দেশে মেট্রো রেল ও শহরে দ্রুত গতির যান ব্যবস্থার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প গড়া হচ্ছে। এই সূত্র মেনেই তৈরি হচ্ছে দিল্লি মেট্রো বা মুম্বই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, কোচি মেট্রো।
রেলকর্তাদের অভিযোগ, শুধুমাত্র কলকাতায় মেট্রো রেল সম্প্রসারণ জোর করে রেলের ঘাড়ে এনে ফেলেছেন তৃণমূলনেত্রী। এমনকী, হাওড়া স্টেশন থেকে রাজারহাট পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর প্রকল্পকেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের হিসেবে রেলে আনা হয়েছে তাঁর আমলেই।