কাটগ্লাসের তৈরি ফাঁকা আতরের শিশিগুলো সে দিনও সাজানো ছিল। ধুলো জমে ছিল হারমোনিয়মটায়। দেওয়াল জোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়নাটাও ধুলোয় আবছা। তবু ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে সে দিকে তাকিয়ে জীবন-সায়াহ্নে কত কথাই মনে পড়ে যেত তাঁর। অতীতের মেহফিলের কথা। মায়ের কথা। কাজী সাহেবের কথা। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসত কত রঙিন স্মৃতি! যোগেন দত্ত লেনের বাড়িতে বসে এ সব কথা ভাবতে ভাবতে সে দিনও তাঁর মন যেন ফিসফিস করে বলে উঠেছিল ‘মাই নেম ইজ ইন্দুবালা’।
গ্রামোফোনের ৭৮ আরপিএম স্পিডে ঘুরতে ঘুরতে রেকর্ডের গানের শেষে শোনা যেত শিল্পীর এমনই ঘোষণা। সে যুগের মহিলা শিল্পীরা রেকর্ডে নিজের নাম ঘোষণা করতেন। এক দিকে খেয়াল, দাদরা, ঠুমরি কিংবা ভজন। অন্য দিকে কাজী সাহেবের গান, ভক্তিগীতি, নাটকের গান কিংবা সিনেমার গান। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী। একাধারে তিনি সঙ্গীতশিল্পী আবার রঙ্গমঞ্চ ও সিনেমার অভিনেত্রী। তিনি ইন্দুবালা দেবী।
আলাপচারিতায়। আঙুরবালা এবং ইন্দুবালা (ডান দিকে)।
ইন্দুবালার জন্ম ১৮৯৯ সালের নভেম্বরে, অমৃতসরে। তাঁর মা রাজবালা ট্র্যাপেজি হিসেবে কাজ করতেন মতিলাল বসুর ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’-এ। পরবর্তী কালে মতিলাল তাঁকে বিয়ে করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর পরিবার এই বিবাহ মেনে নেয়নি। রাজবালার সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শোনা যায় ইন্দুর জন্মের পরে তিনি আর সার্কাসে ফিরতে চাননি। মতিলালও যেন রাজবালার প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। এর পরে শুরু হয় রাজবালার জীবন সংগ্রাম। ফিরে আসেন কলকাতায়। সেই সময় তাঁকে আশ্রয় দেন জীবনকৃষ্ণ ঘোষ। শুরু হয় রাজবালার সঙ্গীতচর্চা। তবে মতিলাল বসু তাঁর মেয়ে ইন্দুবালাকে ভীষণই স্নেহ করতেন। কলকাতায় এলে ডেকে পাঠাতেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে।
রাজবালা চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ের জীবন হোক আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো। তাই তাঁকে পাঠানো হয়েছিল পটলডাঙার একটি হাসপাতালে, শিক্ষানবিশ নার্স হিসেবে। তবে এ কাজ ইন্দুর ভাল না লাগায় সে পালিয়ে আসে বাড়িতে।
শৈশবে মায়ের কাছে গান শিখলেও এ বার নতুন করে শুরু হয় তাঁর সঙ্গীতচর্চা। প্রথমে গৌরীশঙ্কর মিশ্রের কাছে। এ ছাড়াও তালিম নিয়েছিলেন কালীপ্রসাদ মিশ্র, ইলাহি বক্স এবং কিংবদন্তী গহরজানের কাছে। পরবর্তী কালে ইন্দুবালা যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন গিরীন চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, জামিরুদ্দিন খান এবং কাজী নজরুল ইসলাম। পরবর্তী কালে এই ইন্দুবালাই হয়ে ওঠেন নজরুলগীতির প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।
স্মৃতিচারণ করতে করতে ইন্দুবালা দেবী বলতেন, গৌরীশঙ্কর মিশ্রের বাড়িতে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানের নানা স্মৃতি। তার উল্লেখ মেলে বাঁধন সেনগুপ্তের ‘ইন্দুবালা’ গ্রন্থে। “দেখতে দেখতে আবার সেই জন্মাষ্ঠমীর দিন এলো।...গান চলছে। বাজনা চলছে।...ওস্তাদজী এসে আমায় চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাইবে?’...রাজী হয়ে গেলাম।...কিন্তু গাইব কী? চারপাশে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা কেউ হেঁজিপেজি নন। গহরজান, আগ্রাওয়ালি মালকা, নূরজাহান,...হুশনা, জানকীবাঈ, মৈজুদ্দিন...ভয়ে ভয়ে ইমন খেয়াল শুরু করলাম গান শেষ হতে শুধু যে বাহবাই পেলাম তা নয়, অনেকে মিলে আরও গাইতে অনুরোধ করলেন।...ঠুমরি শেষ করে ওঠার উদ্যোগ করছি, গহরজানের আদেশে থেকে যেতে হল। তিনি আরও গান শোনাবার ফরমায়েশ করলেন।...ভয়ে আনন্দে আরও দুখানা গান পরপর গাইলাম।”
১৯১৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় ইন্দুবালার প্রথম রেকর্ড। গান দু’টি ছিল ‘আশা ফুরায়ে গেল’ ও ‘আর মুখে বলে কী হবে’। শুরুর দিকে গান গেয়ে তিনি কোনও অর্থ নিতেন না। রেকর্ডে নামের পাশে লেখা থাকত অ্যামেচার। বাংলা ও হিন্দি গান ছাড়াও তিনি গাইতেন উর্দু, ওড়িয়া, পঞ্জাবি ইত্যাদি ভাষায়।
দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে বাজত ইন্দুবালার গান। ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’, ‘আজ বাদল ঝরে’, ‘বউ কথা কও’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ কিংবা হিন্দি গানের মধ্যে ‘মোহে পনঘট পর নন্দলাল’ ছিল শিল্পীর গাওয়া ‘অলটাইম গ্রেটস’ গানগুলির অন্যতম।
একটি অনুষ্ঠানে বাঁ দিক থেকে পাহাড়ি সান্যাল, পঙ্কজকুমার মল্লিক,
কানন দেবী, অশোককুমার সরকার, ইন্দুবালা দেবী এবং আঙুরবালা দেবী।
১৯২৭ সালে যখন ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সেন্টার (পরবর্তী কালে যা অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে পরিচিত হয়) সম্প্রচার শুরু করে, দ্বিতীয় দিনেই ছিল ইন্দুবালার গান। পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য তিনি ছিলেন বেতারের নিয়মিত শিল্পী। ১৯৩৬ সালে তিনি মহীশূর রাজ-দরবারের সভা-গায়িকা নির্বাচিত হন। সফল গায়িকা হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। ঢাকা থেকে গুজরাত, কিংবা মুম্বই থেকে দিল্লি— তাঁর ডাক পড়ত বিভিন্ন রাজ-দরবারে কিংবা জমিদারবাড়ির অনুষ্ঠানে। তাঁর রেকর্ডের চাহিদা ছিল সমগ্র দেশে জুড়ে।
গানের পাশাপাশি বিভিন্ন নাটকে ও সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯২২ সালে ‘দি রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটারে’ অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এর পরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্টার থিয়েটারে। এ ছাড়াও মদনমোহন থিয়েটার এবং মিনার্ভা থিয়েটারেও কাজ করেছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে ইন্দুবালা হিন্দি ও পার্সি থিয়েটারেও অভিনয় করেন। সিনেমায় তাঁর প্রথম অভিনয় ‘যমুনা পুলিনে’ ছবিতে। এর পরে একে একে তিনি ৪৮টি ছবিতে অভিনয় করেন। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে ছিল ‘নলদময়ন্তী’, ‘মীরাবাঈ’, ‘চাঁদসদাগর’, ‘বিল্বমঙ্গল’ ইত্যাদি। এর মধ্যে বাংলা হিন্দি, উর্দু, পঞ্জাবি ও তামিল ভাষার ছবিও ছিল।
শেষ জীবনে অর্থিক অনটনে পড়তে হয় শিল্পীকে।
১৯৭৬-এ এইচএমভি তাঁকে ‘গোল্ড ডিস্ক’ দিয়ে সম্মানীত করে। ১৯৭৫-এ তিনি পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। এ ছাড়া কোনও সরকারি সম্মান বা পুরস্কার তিনি পাননি। ১৯৮৪ সালের ৩০-এ নভেম্বর মৃত্যু হয় ইন্দুবালার।
দেশ জোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও ইন্দুবালা কখনও রামবাগানের নিষিদ্ধপল্লির বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাননি। এক দিকে খ্যাতির আলো, অন্য দিকে রামবাগানের নিষিদ্ধপল্লির অন্ধকার। এই দুয়ের মাঝেই সুরের আকাশে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ইন্দু।