বুধবার রাত সাড়ে ন’টা। মুষলধারে বৃষ্টি। আচমকা বিকট একটা শব্দ। দরজা খুলে বেরিয়ে রাজলক্ষ্মী বেরা দেখলেন, বাড়ি থেকে নীচে নামার একতলার সিঁড়ির বেশির ভাগ অংশই ভেঙে পড়েছে। এমনকী, তিন ও চারতলার সিঁড়ি থেকেও ভেঙে ভেঙে পড়ছে চাঙর।
সঙ্গে সঙ্গেই রাজলক্ষ্মীদেবী ফোন করে ঘটনাটি জানান তাঁর স্বামী, বিএসএনএলের গাড়ি চালক শশিভূষণবাবুকে। নিজেদের আবাসনের সামনে এসে শশিভূষণবাবুর মাথায় হাত। কোনও মতে তিনি ওই ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বাড়ি ঢুকলেন। তার পরে সারা রাত বাড়ি ভেঙে পড়ার আতঙ্ক নিয়ে রাত জাগল ওই পরিবার।
বুধবার রাতের বৃষ্টিতে এমনই ঘটনা ঘটেছে সল্টলেকের সিসি ব্লকের পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ আবাসনে। বৃহস্পতিবার সকালে শশিভূষণবাবু তাঁর দুই ছেলেমেয়েক নিয়ে কার্যত প্রাণ হাতে করে নীচে নেমে আসেন। কিন্তু আটকে পড়েন রাজলক্ষ্মীদেবী। ওই আবাসনেরই আর একটি পরিবারও এ দিন সকালে একই ভাবে নীচে নামে। বাসিন্দাদের থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন স্থানীয় কাউন্সিলর তুলসী সিংহরায়। খবর যায় মহকুমাশাসক সঞ্জয় দাসের কাছে। পৌঁছয় পুলিশ। এর পরে দমকলকর্মীরা মই এনে দোতলায় আটকে পড়া রাজলক্ষ্মীদেবীকে উদ্ধার করেন।
পরে ঘটনাস্থলে এসে বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন বিএসএনএল-এর আধিকারিকেরা। ওই আবাসনে যে ক’টি পরিবার রয়েছে, তাদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থার কাজ শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি, বাঁশ দিয়ে একটি অস্থায়ী সিঁড়িও বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যেই তৈরি করেছেন কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এই টুকরো ছবিই একমাত্র নয়। প্রায় ৩০ একর এলাকা জুড়ে থাকা ওই জায়গার অধিকাংশ আবাসনের ছবিটা এমনই। পাশাপাশি, গোটা চত্বর জুড়ে জঙ্গলে ছয়লাপ। নিকাশির অবস্থাও তথৈবচ।
বাসিন্দাদের কথায়, তাঁরা বাস করছেন একটি ‘মৃত্যুকূপে’।
কেমন সেই ‘মৃত্যুকূপ’? কারও বাড়ির বারান্দা নেই, ভেঙে পড়েছে। কোথাও আবার চারতলা থেকে একতলা পর্যন্ত সিঁড়ির অধিকাংশ ভাঙা। বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে চাঙর। শুধু সিঁড়ি-ছাদ-বারান্দাই নয়, বাড়ির ভিতরের চেহারাটা আরও করুণ। কোথাও সিলিংয়ের অধিকাংশ খসে গিয়ে লোহার খাঁচা বেরিয়ে পড়েছে, আবার কোথাও শৌচাগার উপচে পড়ছে নোংরায়। আবাসনের এক বাসিন্দা অনন্ত দাস বলেন, “বর্ষা এলেই আতঙ্ক হয়। কোন দিন হয়তো পুরো বাড়িটাই ভেঙে পড়ে যাবে।”
এ তো গেল শুধু আবাসনের দশা। গোটা পাড়ায় ঢুকলে মনে হবে, কোনও জঙ্গলের মাঝে কিছু ভাঙাচোরা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আবাসনের ভিতরে অত বড় মাঠ একনজরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু গোলপোস্ট দেখলে মাঠের অস্তিত্ব বোঝা যায়। গোটা মাঠ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আস্তানা তৈরি হয়েছে এই আবাসনে।
যে বছর সল্টলেকে ডেঙ্গির প্রকোপ হয়েছিল, সে বার এই আবাসনেও থাবা বসিয়েছিল ডেঙ্গি। কারণ, অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যায় আবাসনে, এতই খারাপ নিকাশি। এই আবাসনে বিএসএনএল ও ডাককর্মীরা থাকেন। বিএসএনএলের ৫৫৭টি ও ডাক বিভাগের ৪০০টির কিছু বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে। সব মিলিয়ে বাসিন্দাদের সংখ্যা সহস্রাধিক।
কিন্তু এমন অবস্থা হল কেন? স্থানীয় কাউন্সিলর, তৃণমূলের তুলসীদেবীর অভিযোগ, বিএসএনএল কর্তৃপক্ষকে একাধিক বার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি। যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনা ঘটবে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ফ্ল্যাট ব্যবহার করার জন্য মাসে ৬-৬.৫ হাজার টাকা এবং জল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৪০ টাকার বেশি বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। অথচ গত ১২-১৪ বছর রক্ষণাবেক্ষণের কোনও কাজ হয়নি। আবাসনের অবস্থা প্রতিনিয়ত আরও খারাপ হচ্ছে। অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেননি বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ।
কী বলছেন বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ? বিএসএনএলের স্থানীয় অফিসে বসে সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার সুভাষ পাল বলেন, “উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ একেবারে হয় না তেমন নয়। তবে আবাসনগুলিতে যে ধরনের মেরামতি প্রয়োজন, সে কাজ হয়নি। আর্থিক সমস্যা রয়েছে।” এর বেশি তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু অন্য অনেক অফিসারই কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, ওই আবাসনে বিএসএনএলের অধিকাংশ বিল্ডিং বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।