গড়িয়াহাটে বেদখল ফুটপাথ
দোকান ফুটপাথের ধারে। কিন্তু দোকানের মালপত্র রাখা হয়েছে ফুটপাথ জুড়ে।
কলকাতা শহরে এ চিত্র প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে পথচলতি মানুষের। কোথাও বা ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় ঘাঁটি গেড়েছে হকারের দল। পুরসভার হিসেবে, এরা সবাই জবরদখল করে রয়েছে রাস্তা, ফুটপাথ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। যাতায়াতের পথ ছেড়ে তাঁদের সুষ্ঠু ভাবে বসাতে কোনও প্রচেষ্টা নেয়নি পুর-প্রশাসন। আর তাই কলকাতাকে ‘লন্ডন’ বানানোর পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন যাঁরা, ভোটের আগে সেই তৃণমূল বোর্ডের ‘ভূমিকা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠছে নাগরিক মহলে। আবার প্রয়োজনে হকারদের পুনর্বাসন দিয়েও যে মানুষের সুবিধা করা যায়, তার নজিরও সম্প্রতি দেখা গিয়েছে বেহালায়।
চিত্র ১: মানিকতলা থেকে খন্নার দিকে এপিসি রোড। রাস্তার ডান দিকে ফুটপাথের ধারে রয়েছে লোহালক্কড়ের দোকান। কিন্তু লোহার মাল-সহ নানা ধরনের মেশিন, যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে ফুটপাথ জুড়ে। আর সে সব টপকে ফুটপাথে চলাচল প্রায় দুঃসাধ্য।
চিত্র ২: লালবাজার-মুখী বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের ডান দিকে সাইকেলের দোকান। দোকান রাস্তার পাশে থাকলেও তার যাবতীয় পসরা সাজানো হয়েছে ফুটপাথ ঘিরে। রীতিমতো ড্রিবলিং করে পথ চলতে হয়। ওই সব দোকানের পাশেই আবার স্থানীয় কাউন্সিলরের বাড়ি।
চিত্র ৩: বিকেল সাড়ে ৫টা বাজলে খাস কলকাতা পুরভবনের সামনেই বসে পড়ে হকার। নিউ মার্কেট যাওয়ার রাস্তা জুড়ে বসা হকারের কারণে গাড়ি তো দূর অস্ৎ, মানুষের নড়াচড়া করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
চিত্র ৪: বড়বাজারের মহাত্মা গাঁধী রোড। টানা ফুটপাথ ঘিরে রয়েছে পাশে থাকা দোকানের মালপত্র। তারই ফাঁকে আবার জবরদখল করে থাকা হকারের দল। গড়িয়াহাট, ব্রেবোর্ন রোড থেকে শুরু করে শহরের বেশ কিছু ব্যস্ত এলাকা এ ভাবেই চলছে।
কেন এই হাল? জবাব দেননি মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়-সহ বাজার দফতরের মেয়র পারিষদ কেউই। তবে এক মেয়র পারিষদ মন থেকে মনে করেন, শহরবাসীর কথা ভেবে পুর-প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাঁর কথায়, “যে সব দোকান ফুটপাথে মাল রেখে ব্যবসা করছে, অন্তত তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করার মতো কোনও পদক্ষেপ করতেই পারে পুরসভা।” তিনি জানান, বাম বোর্ডের আমলেও ওই দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। এখনও সে ভাবেই চলছে।
পুরসভার বাজার দফতরের এক অফিসার জানান, হকারদের নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই বেশি মাথা ঘামাতে চায় না। মূলত তা ভোটের কারণেই। অতীতে বাম বোর্ডের আমলে অপারেশন সানশাইন হয়েছিল বটে। কিন্তু রাজনৈতিক মদতেই তা স্থায়ী ভাবে লাগু করা যায়নি। ওই কর্তা জানান, তৃণমূল-শাসিত বর্তমান পুর-বোর্ডও নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তা থেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হকার সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও সে সময়ে জানিয়েছিলেন, নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তা সাফ রাখতে হবে। পরিষ্কার করতে হবে ঢোকা বা বেরোনোর পথও। এর জন্য যা করার, পুর-প্রশাসন তা করবে।
কিন্তু এক ‘অজ্ঞাত’ কারণে সেই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করা হয়নি। নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তা সাফ করার সেই উদ্যোগ আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছে পুর-প্রশাসন। ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে হকারদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাচ্ছে না।
কিন্তু যে দোকানদারেরা ফুটপাথ ঘিরে ব্যবসা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হবে না?
পুর-প্রশাসনের কোনও কর্তা এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে এক মেয়র পারিষদ জানান, নিউ মার্কেট চত্বরে হকারদের থেকে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা তোলা ওঠে। যা প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা, পুলিশ থেকে পুরসভাতেও ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়। হকার উচ্ছেদ অভিযানে তাই মন নেই কারও। যা মালুম হল বড়বাজারে গিয়ে। কীসের জোরে বসছেন জানতে চাইলে এক দোকানদার সাফ বলেন, “সব বন্দোবস্ত হয়ে আছে। তাই কোনও ভয় নেই।”
তবে ইচ্ছে করলে পুরসভা যে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে হকারদের অন্যত্র সরিয়ে দিতে পারে, তারও নমুনা মিলেছে বুধবার। বেহালায় ডায়মন্ড হারবার রোডে জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রো স্টেশনের জন্য জায়গা মিলছিল না। নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ছিলেন গোটা ষাটেক হকার। এ দিন মেয়র শোভন শোভন চট্টোপাধ্যায় জরুরি ভিত্তিতে ওই হকারদের সরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। তবে ওই হকারদের বসানোর জন্য পুরসভারই একটি পার্কিং লট তুলে সেখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন তিনি।
মেয়রের ওই নির্দেশের পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, মেট্রো স্টেশনের কাজের জন্য ফুটপাথ মুক্ত করতে যে সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে, শহরের অন্যত্র তা দেখা যায় না কেন। প্রসঙ্গত, মঙ্গলবারই কালীঘাটে ফুটপাথ জুড়ে হকার বসা নিয়ে স্থায়ী দোকানদের সঙ্গে তাঁদের মতবিরোধ শুরু হয়েছে। যা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। পুলিশ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, ওটা পুরসভার বিষয়। এতে তাদের কিছু করার নেই। এই পরিস্থিতিতে ভোটের আগে তৃণমূল শাসিত পুরবোর্ড কতটা নখ-দাঁত বার করতে পারে, সেটাই এখন দেখার।
বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন দেবস্মিতা চক্রবর্তী।