রাজারহাটের ইকো পার্কের সেই কাচঘর। —ফাইল চিত্র।
জলের মাঝে কাচের ঘরে শিল্পের মন বুঝতে বসবে রাজ্য। ক্ষমতার অলিন্দ ছেড়ে তাদের সমস্যা-অভিযোগ শুনতে যাবে প্রকৃতির কোলে। শিল্প সংক্রান্ত ‘কোর কমিটি’র বৈঠক এ বার আর নবান্নে হবে না। বসবে রাজারহাটের ইকো পার্কে (প্রকৃতি তীর্থ) জলে ঘেরা দ্বীপের ভিতরের কাচঘরে। কিন্তু রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে খোদ শিল্পমহলেরই প্রশ্ন, শুধু জায়গা বদলে লাভ হবে? কাজ হবে নিছক বাহ্যিক আড়ম্বরে? তাদের আক্ষেপ, জমি নীতি, পরিকাঠামো এ সব ঠিক না করে শুধু এই ধরনের চটকে আর যা-ই হোক লগ্নি আসবে না। দিনের শেষে হাতে পেন্সিলই থেকে যাবে পশ্চিমবঙ্গের।
তৃণমূল সরকার কোর কমিটির ওই বৈঠক চালু করার পর প্রথমে তা হত মহাকরণে। তার পর নবান্ন। এ বার তা হতে চলেছে ইকো পার্কে। আগামী ১৬ জুন বিকেলে সেখানে ‘সবুজসাথি’ দ্বীপের কাচঘরে শিল্পমহলের মুখোমুখি হবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও আমলারা।
সরকারি সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনাতেই এই উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই এই আলোচনায় বণিকসভার কর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নিগমের এমডি কৃষ্ণ গুপ্ত। শিল্প কর্তাদের বলা হয়েছে নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট আগে পার্কে পৌঁছতে। কারণ, পার্ক থেকে নৌকায় চেপে পৌঁছতে হবে দ্বীপের কাচঘরে। এ জন্য থাকবে চারটি নৌকা। যা জেনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পকর্তার সরস টিপ্পনি, শিল্পের জন্য সবার আগে জমি লাগে। শুধু জলে ভেসে শিল্প হবে তো?
হয়তো এ কারণেই এই সরকারি ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েও শিল্পমহলের একাংশের প্রশ্ন, কোর কমিটির একের পর এক বৈঠক তো হয়েই চলেছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ আদৌ কিছু হচ্ছে কি? মঙ্গলবার গত তিন বছরের খতিয়ান দিয়ে রাজ্য হাজার-হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের প্রস্তাব পাওয়া ও তা বাস্তবায়নের দাবি করেছে ঠিকই। কিন্তু শিল্পমহলের অনেকেরই দাবি, তার মধ্যে অনেক প্রকল্পই বাম আমলে প্রস্তাবিত। তাঁদের মতে, নতুন করে লগ্নি তো তেমন আসেইনি, বরং জমি জট-সহ বিভিন্ন কারণে থমকে রয়েছে একাধিক বড় পুরনো প্রকল্প। তাই জায়গা বদলের থেকে এ বিষয়ে রাজ্যের মনোভাব ও নীতি বদল আগে জরুরি বলে মনে করছে তারা। জায়গা বদলের প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ এঁটেছেন নিগম ও শিল্প দফতরের কর্তারাও।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, ইকো-পার্ককে অন্যতম শো-কেস হিসেবে তুলে ধরার অঙ্গ হিসেবেই এই পদক্ষেপ করছে রাজ্য। হিডকো-র চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বৈঠকের জন্য প্রকৃতি তীর্থ নির্বাচিত হওয়ায় আমরা খুশি।” তিনি জানান, আমজনতাকে যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয়, সে জন্যই পার্কের ছুটির দিনে (সোমবার) ওই বৈঠক হচ্ছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত এবং এমসিসি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সঞ্জয় অগ্রবাল। কল্লোলবাবুর বক্তব্য, এটি শিল্পমহলকে নয়া বার্তা দেবে। আবার সঞ্জয়ের মতে, অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যের তুলনায় অনেক সময়ই এমন পরিবেশে খোলামেলা আলোচনা কার্যকরী হয়।
কিন্তু এর উল্টো দিকে একই রকম জোরালো ‘অপর পক্ষের’ গলা। তাঁদের মতে, এ ধরনের জায়গা বাছা নিয়ে আপত্তি নেই। কিছু কর্মীকে নিয়ে বৈঠকে বসার ক্ষেত্রে কর্পোরেটও এমনটা হামেশাই করে থাকে। কিন্তু সেই আলোচনার একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ আগে থেকে ঠিক করা থাকে। সমাধান খোঁজার জন্য আগে থেকে চিহ্নিত করা হয় মূল সমস্যাগুলিকে। সেখানে কয়েক জন শিল্পকর্তার বক্তব্য, কোর কমিটির বৈঠক শুধুমাত্র রেওয়াজে পরিণ ত হয়েছে। সাধারণত যার জন্য আলোচনার নির্দিষ্ট কোনও বিষয় আগে থেকে ঠিক থাকে না। মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের তরফে কিছু ঘোষণা করা হয়। যা সরকার এমনিতেই করতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, শুধু এ জন্য নিজেদের কাজের সূচি বদলে সেখানে ‘হাজিরা দেওয়া’ তাই প্রায়শই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
উল্লেখ্য, শিল্পমহলের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে বাম আমলে তিন মাস অন্তর বণিকসভার কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসা শুরু করেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। পরে শিল্পের কোর কমিটি গড়েন মমতা। তাতে শিল্পমন্ত্রী-সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মন্ত্রী এবং আমলারা রয়েছেন। গোড়ায় ১৫ দিন অন্তর এই কমিটির বৈঠক হত নিগমের দফতরে।