এই সংগ্রহগুলি বাঁচাতেই উদ্যোগ। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
প্রাচীন কাঁথা থেকে কাঠশিল্প, পট থেকে মুখোশ বাক্সবন্দি হয়ে আছে বাংলার দুর্মূল্য নানা লোকশিল্প। ঐতিহ্যের সম্ভার দেখানোর চেষ্টায় তহবিলের খোঁজে নামলেন গুরুসদয় সংগ্রহশালার কর্তৃপক্ষ।
গ্রামবাংলার সমাজজীবনের হরেক ছবি জীবনভর কাঁথায় তুলে রেখেছিলেন চপলাবালা রায়। আর এক বধূ মানদাসুন্দরী দাসী ছোট বয়সে বিধবা হয়ে জমিদার বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। এঁদের মতো অনেকে বয়নশিল্পে ফুটিয়ে তুলেছিলেন জীবনের নানা কথা, গল্প। এ ধরনের বেশ কিছু কাঁথা ছাড়াও প্রাচীন মন্দিরের দরজার ফ্রেম, পুরনো তাস, নানা ধরনের পট, স্ক্রলপেন্টিং প্রায় ২৩০০ লোকশিল্প সংগ্রহ করেছিলেন গুরুসদয় দত্ত। মূলত ১৯২৯ থেকে এক দশকের সংগ্রহ নিয়ে ৫১ বছর আগে ঠাকুরপুকুরে প্রায় ৫ বিঘা জমিতে তৈরি হয় সংগ্রহশালা।
সংগ্রহশালার সম্ভার এখন চার হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু লোককে দেখানো যাচ্ছে এর প্রায় সাতশো। সংগৃহীত ১১০টি কাঁথার মধ্যে গ্যালারিতে গোটা পঁয়ত্রিশ। গ্রন্থাগারের হাজার দুই বইয়ের মধ্যে দুর্মূল্য বেশ কয়েকটি গুরুসদয়বাবুর সংগৃহিত। সেগুলিও পড়ে আছে অনেকটা অযত্নে, অনাদরে। কেন? সংগ্রহশালার কার্যকরী সচিব বিজনকুমার মণ্ডল বলেন, “কারণ অর্থাভাব, লোকাভাব। সঙ্কট কাটাতে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছি।”
সংগ্রহশালার পুরনো ভবনটিতে গ্যালারি ছাড়াও আছে গ্রন্থাগার, সংরক্ষণ ইউনিট। সংগ্রশালায় নজর কাড়ে প্রায় সাত ফুট দীর্ঘ পাঁচ ফুট চওড়া ‘সূচনি কাঁথা’, দু’দিকে নকশা করা ‘দো-রোখা কাঁথা’, কালীঘাটের পট, সাবেক ‘দশাবতার তাস’। “এগুলিই বাংলার নিজস্ব তাস। এখন আমরা যে তাস দেখি, সেগুলি বিদেশি”, জানালেন কর্মীরা। দর্শকদের কাছে আরও বেশি দ্রষ্টব্য দেখাতে তৈরি হচ্ছে প্রায় ২৪০০ বর্গফুটের নতুন ভবন। এ কারণে ২০০৮-এর পরে দু’দফায় সাংসদ অর্জুন সেনগুপ্তের তহবিল থেকে বরাদ্দ হয় ৪৫ লক্ষ টাকা। কর্তৃপক্ষের হিসেবে, “ভবন-নির্মাণ শেষ করতে দরকার আরও প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। সঙ্গে ৩০ লক্ষ টাকা খরচ করলে পর্যাপ্ত শো-কেস ও আলোর ব্যবস্থার পরে পাঁচটি গ্যালারি খুলে দেওয়া সম্ভব।” সে ক্ষেত্রে আরও অন্তত ১২০০ দ্রষ্টব্য দেখানো যাবে।
সাংসদ তহবিলের অনুদানের জন্য কয়েক জনকে অনুরোধ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানান, “এর পাশাপাশি, সাহায্য চাওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রকের কাছে।” ১৯২৫ সালে গুরুসদয় দত্ত বার করেন মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গলক্ষী’। ১৯২৯-এ শুরু করেন ‘গ্রামের ডাক’ নামে সাময়িকী। এগুলির মাধ্যমে তিনি নবীন প্রজন্মকে উত্সাহ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। গ্রন্থাগারে এ রকম দুষ্প্রাপ্য নানা সাময়িকী ও বই নষ্ট হওয়ার মুখে। বিজনবাবু বলেন, “প্রায় ১১ বছর আগে কেন্দ্রীয় টাকায় বই-বাঁচানোর কিছু চেষ্টা হয়েছিল। ডিজিটাইজেশনের টাকা নেই। গ্রন্থাগারিক নেই। কী করব!”
গুরুসদয় দত্তর জন্ম শ্রীহট্টে, ১৮৮২-তে। এফ এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে স্বর্ণপদক পেয়ে বিলেতে যান। আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন প্রথম ভারতীয় হিসেবে। বার-অ্যাট ল’ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পান। দেশে ফিরে প্রশাসনের পাশাপাশি স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করেন ব্রতচারী আন্দোলন। লোকনৃত্য, লোকসঙ্গীতের প্রসারের সক্রিয় চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ করতেন হরেক বিচিত্র লোকশিল্প। ১৯৩২-এ তাঁর ওই সংগ্রহ দেখে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেগুলিকে ‘প্রকৃত জহুরির কাজ’ বলে চিহ্নিত করেন। এই সংগ্রহ ও ব্রতচারী আন্দোলনের ব্যাপারে গুরুসদয়বাবু অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্ত্রী সরোজনলিনী দেবীর কাছে।
পেন্টিংগুলি বাঁচাতে কী করছেন? বিজনবাবুর জবাব, “কেন্দ্রের দেওয়া ১২ লক্ষ টাকায় ২০০৮-এ লখনউ থেকে ৫৫টি স্ক্রল পেন্টিং সংরক্ষণ করিয়ে এনেছিলাম। আর ছোটগুলি এখানকার বিভাগে সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে।” এই সঙ্গে বলেন, সংরক্ষণের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে উপরমহলে।
সংগ্রহশালার ১৩ জন কর্মীর ১০ জন স্থায়ী। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের টাকা না-পেয়ে তাঁরা হতাশ। এ প্রসঙ্গে সচিবের বক্তব্য, “পঞ্চম বেতন কমিশনের হিসেবে ওঁদের বেতন খাতে বছরে ৩১ লক্ষ টাকা লাগে। এই টাকা আর রক্ষণাবেক্ষণের খাতে ৫ লক্ষ মোট ৩৬ লক্ষ কেন্দ্র দিয়েছে। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের টাকা বরাদ্দ করতে ডেভলপমেন্ট কমিশনারের কাছে অনুরোধ করেছি।”
আর্থিক সঙ্কট থাকলেও গুরুসদয়বাবুর আন্দোলন ও ভাবনা বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে চান সংগ্রহশালা-কর্তৃপক্ষ। বিজনবাবু বলেন, “যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলে আমরা যে কোনও প্রতিষ্ঠানে এক ঘণ্টার পাওয়ার পয়েন্ট প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব।” ‘বাংলার বিয়ের গান’ থেকে নববর্ষ সংগ্রহশালায় আয়োজিত হচ্ছে হরেক অনুষ্ঠান, আলোচনাচক্র।