এই শহর তখনও আমার শহর হয়নি। যখন এসেছিলাম তখন খুবই ছোট। এখনও মনে আছে বাবার হাত ধরে, ভোরের ঘুমভাঙা চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে নীল-সবুজের কোলাকুলি দেখতে দেখতে হঠাৎ আকাশে ফুড়ে উঠত হাওড়া ব্রিজের চুড়ো। অমনি বাবা বলে উঠতেন, ‘এই তো কলকাতা এসে গেল।’ এই ভাবেই আসা যাওয়ার লুকোচুরিতে আমার আলাপ হয় এই শহরের সঙ্গে। পৃথিবীর মানচিত্রে এর স্থান বিন্দুতে হলেও ইতিহাসের পাতায় এ শহরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
সুচিত্রা মিত্র এবং মনীষা
আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মফসসলে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। এখন তাকে আর মফসসল বলা যাবে না। তবে, আমি যে সময়ের কথা বলছি তাতে ওই মফসসল শব্দের আশা করি সম্মানহানি হবে না। চার দিকে খোলা মাঠ ও বিস্তৃত আকাশের দিগন্তরেখা যেন দেখা যেত। সাঁওতালপাড়ার মাঝখান দিয়ে সাইকেল ছুটিয়ে যাওয়া যেত যে দিকে দু’চোখ যায়। ভিড় বলতে ছিল সাইকেল, রিকশা আর কিছু মানুষের। এঁদের মধ্যেই দেখা যেত কখনও মোহরদিকে (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়), কখনও শান্তিদাকে (শান্তিদেব ঘোষ), কখনও বা বাচ্চুদিকে (নিলীমা সেন)। তাঁরা রিকশাতে চলেছেন গান শেখাতে সঙ্গীত ভবনে। পথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন বাড়ির খবর। কী আন্তরিকতা ছিল তাঁদের— ভাবলে এখনও অনাবিল এক আনন্দে মন ভরে যায়!
সহজ সরল জীবনে আমার বেড়ে ওঠা, তাই ভিড়কে সমীহ করে চলতাম। বেশি চেঁচামেচি, উত্তেজনা পছন্দ হত না। কিন্তু গান গাইব বলে যখন দাদাই-এর হাত ধরে কলকাতায় এলাম, ওরে বাবা এত সর্বদাই প্রাণবন্ত এক শহর! দিন বা রাত, কলকাতা জেগেই থাকে। ঘুমোয় না। দেখতাম, রাস্তা দিয়ে অনবরত ছুটছে বাস, ট্রাম। আর ছুটছে মানুষ। এখন অবশ্য অটোরিকশা আরও বেশি ছুটছে। কারও যেন দু’দণ্ড সময় নেই। দাদাইয়ের পাঞ্জাবির হাতাখানাকে শক্ত করে ধরে রাখতাম যাতে হারিয়ে না যাই। অনেক বার হয়েছে দাদাই বাস থেকে আগে নেমে গিয়েছে, আমি নামতে পারিনি। সে কি অবস্থা! প্রায় কাঁদতে কাঁদতে পরের স্টপেজে নেমেছি।
দাদা মনোজ মুরলি নায়ারের সঙ্গে মনীষা।
এই শহরের ওপর আমার দুর্বলতার আরও একটা বড় কারণ, কলকাতার পুরনো বনেদি বাড়িগুলো। ছোটবেলায় ‘জীবনস্মৃতি’ পড়ার সময় খুব ইচ্ছে করত, কবির সেই বারান্দার রেলিংগুলো এক বার নিজের চোখে দেখে আসি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আমার কাছে চির কালের চেনা-অচেনা পরদেশি। গান গাইতে এখনও যদি ওখানে যাই, মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। এক দিন উত্তর কলকাতার এক রাস্তা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল। যেন নতুন করে আবার ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় হারিয়ে গেলাম। যেখানে দাদা সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ বালক রবিকে গাড়িতে করে স্কুলে যাওয়ার ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণনা করতেন। কী অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল সে দিন, এখনও কাউকে বোঝাতে পারিনি! এমনও দিন গিয়েছে, যেন সেই সময়ের ওই সব চরিত্রগুলি আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আনমনে কথা বলতাম। পরবর্তীতে সেই স্কুলের জীর্ণদশা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কলকাতার আর এক মজার দিক, এখানকার মানুষজন। সব কিছুতেই এত মেতে উঠতে পারে, পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা হয় কি না জানি না। পুজো, বইমেলা, রবীন্দ্র-জন্মোৎসব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট— সবেতেই আছে। পাশাপাশি, এই শহরেই আছে বৃষ্টিতে জল জমে যাওয়া, পাশের বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া। জীবন যেন থেমে নেই। গতিহীন হয় না কখনও। চলছে তো চলছেই। এ জীবন বেশ মজার। আমার তো খুব ভাল লাগে। গড়িয়াহাটের বাজারে গিয়ে দর কষাকষি, অটোরিকশায় চড়ে সহযাত্রীদের নানা মজার ঘটনা শুতে পাওয়া। এমন গতিতে আমিও কেমন আপন হয়ে গেলাম।
দুই শিল্পী: উষা ও মনীষা
এই শহর আমায় নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। সবাই কেমন আমাকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে। কিছু মন্দ কিছু ভাল-র মধ্যেও এই শহর আমাকে শিখিয়েছে, ‘নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কখনও থেমে থাকতে নেই। কঠিন হয়ে এগিয়ে যেতে হবে জীবনের দিকে।’ গান গাইতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেতে হয় আমাকে। সারা দিনের কাজের শেষে পাখিরা যেমন তাদের নীড়ে ফিরে স্বস্তি পায়, তেমনই ভিন্ সে সব জায়গা থেকে এই শহরের মাটিতে আমার ক্লান্ত পা পড়লেই মনে হয় মায়ের কোলে ফিরে এলাম।
এই শহর, এই তো মা।
লেখক: সঙ্গীতশিল্পী