বিয়ের পরে নবদম্পতি। —নিজস্ব চিত্র।
থঙ্গবলিকে পাত্র পেয়েছিলেন বাবা। মেয়ের মন সায় দেয়নি।
পরনে আটোসাঁটো সাউথ-কটন, হাত বাড়িয়ে রাহুল মিঠাইওয়ালা। উত্তর ভারতের একটি ছেলের সঙ্গে পালাল দক্ষিণি কন্যে।
‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এরও আগে ‘জব উই মেট’। শাহিদ কপূরকে নিয়ে একই রকম ভাবে পালানোর ছক কষেছিলেন করিনা কপূর। আবার দিলওয়ালে-তে মেয়ে বলল, পালাব। মেয়ের মা বললেন, পালা। বেঁকে বসল পাত্র নিজে। মেয়ের বাবাকে বলতে হবে, যা সিমরন যা! তবে চার হাত এক হবে!
বাস্তবের রোজ রাইনা আর পলাশ করের গল্পটাও অনেকটা এই কিসিমের।
মেয়ে নাগা, ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ছেলে হিন্দু ঘরের। মণিপুরের সেনাপতি জেলার সাংখুমাই গ্রামে বাড়ি রোজ়ের। পলাশরা খাঁটি বাঙালি, বাড়ি বিরাটিতে। কর্মসূত্রে দু’জনেই দিল্লিতে। তবু মিলের চেয়ে গরমিলেরই লম্বা ফিরিস্তি। ভিন্ন জাত, আলাদা পাত, একেবারেই অন্য রকম সংস্কৃতি দুই বাড়ির। অতএব লাগ ভেল্কি!
পর্দার দীপিকা-করিনার মতো ‘ইলোপ’ চেয়েছিলেন রোজ-ও। শেষমেশ যদিও ভেস্তে যায় ছক। পালিয়ে নয়, সম্প্রতি প্রথা মেনেই বিয়ে হয়ে গেল দু’জনের। গোড়ার আপত্তি কাটিয়ে একজোট দুই পরিবারও। ডিসেম্বরের শীত পড়ার আগেই বাঙালি বাড়ির বউভাত খেয়ে গেলেন প্রায়-গোটা একটি মণিপুরী পরিবার।
পালানোর ‘ষড়যন্ত্রে’র কথা নাতির মুখে প্রথম শুনেছিলেন ঠাকুমা। ২০০৮ সালের কথা। শুনেই জানিয়ে দেন, ‘‘এ বিয়ে হইব না।’’ রোজ়কে সরাসরি হুমকি দেন পলাশের মা। ‘ময়ঙ্গ’ মানে, অ-মণিপুরী ছোকরাকে বিয়ে করা নিয়ে অশান্তির ঝড় ওঠে মণিপুরেও। রোজের বাবা কে রং টমাস পেশায় স্কুলশিক্ষক। ধর্মপ্রচারও করেন। মানুষকে বোঝান, কেন নিজেদের জাতেই বিয়ে করা উচিত। পলাশকে নিয়ে বড়সড় ধর্মসঙ্কটে পড়েছিলেন তিনি। কেঁদে ভাসাচ্ছিলেন রোজের মা। ফলে সব মিলিয়েই মাথায় ‘কুচিন্তা’ আরও জোরালো হয়। পলাশকে এক দিন নিভৃতে বলেন রোজ “চলো পালাই।”
মণিপুরে পালিয়ে বিয়ে ব্যাপারটা কিন্তু জলভাত। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘নুপি চেনবা’। বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষেই মণিপুর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন এলিজাবেথ আর রাজন। এলির বক্তব্য, “পালানোটাই তো রেওয়াজ আমাদের! আশি থেকে নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়েই পালিয়ে বিয়ে করে ওখানে। পণের ঝামেলা নেই, আবার নির্ঝঞ্ঝাট বিয়েও মিটে গেল! প্রথম দিকে পরিবারের আপত্তি থাকে, কিন্তু দিন তিনেক পর ওরা ফিরে এলেই সব ফিকে।” বছর খানেক আগে ঠিক এ ভাবেই বিয়ে করেছেন রোজের এক দাদা বস্কো। পেশায় সাংবাদিক। বোনের বিয়েতে এসে জানালেন, “পালিয়ে প্রথম রাত বাইরে কাটানোর পর ছেলেরা নিজেই ইলোপের খবর পাঠায় বাড়িতে। বরপক্ষের লোকেরা তার পর প্রস্তাব নিয়ে যায় মেয়ের বাড়িতে। এর নাম ‘হাইদোকপা’। তারপর বিয়ে।” এমনকী এ-ও শোনা যায়, সম্বন্ধ করে বিয়ের (হাইনাবা) পরে অনেক সময় বাড়ির বড়রাই বর-কনের কান ভারী করেন পালাতে বলেন। মধ্যপ্রদেশের ভিল আদিবাসী অধ্যুষিত কিছু জেলায় আবার বসে ‘ভাগোরিয়া হাট’। ইলোপ সেখানে পরব, রীতিমতো গণ-স্বয়ম্বর যেন।
তবু ওঁরা কিন্তু পালাননি শেষ পর্যন্ত। বরং দু’জনেই চেয়েছিলেন সমঝোতা। প্রায় বছর পাঁচেক চলে যৌথ প্রয়াস। অবশেষে গলে বরফ। রানাঘাটের দিদাও নাক-মুখ কুঁচকে ছিলেন দীর্ঘদিন। তার পর মাস খানেক আগে বলেই ফেললেন, “দেখতে ভাল নয়, তবে মেয়েটা ভালই।” একখানি সোহাগের ডাকনামও দিলেন ‘ফুলটুসি’। মেয়েটির যে ভাই ফৌজে, মাস খানেক আগেও হুমকি দিয়েছিলেন, “যাকে খুশি বিয়ে করো, কিন্তু মণিপুরে ঢুকলেই পা কেটে ফেলব।” এখন বরফ গলেছে সে প্রান্তেও। বিরাটিতে আসার কথা ছিল তাঁর। ছুটি মেলেনি। তাই সীমান্ত থেকেই শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন নবদম্পতিকে। পালানোর ছক নিয়ে হাসাহাসি অবশ্য থামেনি।
অষ্টমঙ্গলা ইত্যাদি সেরে গত সপ্তাহেই দিল্লি ফিরে গিয়েছেন রোজ ও পলাশ। সফদরজঙ্গ এলাকায় থাকেন ওঁরা। সেখানে উত্তর-পূর্বের বাসিন্দা প্রচুর। কিন্তু পাড়া ছেড়ে বেরোলে মাঝেমাঝেই নানা জনের নানা কটাক্ষ, অটোর জুলুম। শুধু রাজধানীতে গত তিন বছরে উত্তর-পূর্বের বাসিন্দাদের উপর হামলার ঘটনা অন্তত পাঁচ গুণ বেড়েছে, এ তথ্য দিল্লি পুলিশেরই। রোজ অবশ্য চিরকালই ডাকাবুকো। প্রায়শই প্রতিবাদে ঝাঁপান। পলাশ বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করেন। মজা করে বলেন, “আসলে কী বলুন তো, নাগা রক্তে অপমান হজম হয় না বোধ হয়!” বন্ধু রাজন আবার আরও এক কাঠি সরেস। বলেন, “পাশে তো এ বার গোটা একটা বাঙালি পরিবার। প্রতিবাদী রোজকে আর আটকায় কে?”