ব্রজকিশোর মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
প্রথম কন্যাসন্তান বধির। তাঁকে নিয়ে লড়াইয়ের মধ্যেই ছেলে হয় পূর্ব বর্ধমানের গলসি-২ ব্লকের একটি গ্রামের বাসিন্দা অসীমকুমার মণ্ডল এবং তাঁর স্ত্রী তন্দ্রার। কিন্তু সেই ছেলের দেড় বছরের মাথায় বোঝা যায়, বধির সে-ও! দুই সন্তানকে নিয়ে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? সর্বশিক্ষা মিশনের শিক্ষাবন্ধু হিসাবে কাজ করে মাসে আট হাজার টাকা রোজগার করা অসীমের পক্ষে বেশি কিছু করারই বা সামর্থ্য কোথায়? ঘিরে ধরতে থাকা অবসাদেএক দিন ওই দম্পতি ঠিক করেন, দুই সন্তানকে মেরে নিজেরা আত্মঘাতী হবেন। পরিকল্পনা হল ঘুমের ওষুধ খাওয়ার!
কিন্তু শেষ মুহূর্তে আটকে গেল হাত। আত্মহত্যা করা হল না। ভাগ্যিস হয়নি। সেই বধির মেয়ে এখন কথা বলতে শিখেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করছেন তিনি। ইচ্ছে শিক্ষিকা হওয়ার। আর জন্ম থেকে বধির সেই ছেলে এই সাফল্যকেও পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন। কথা শিখে নেওয়াই শুধু নয়, এখন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে চলেছেন তিনি। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ব্রজকিশোর মণ্ডল নামে আঠারো বছরের ওই তরুণ পাশ করেছেন ডাক্তারি পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট (নিট)। ছেলের কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে অসীমের। বলেন, ‘‘যে দিন ঘুমের ওষুধ খাব ঠিক করেছিলাম, শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, চেষ্টা করলে আমরা পারি, পারবই। মনে হয়েছিল, এক বার চেষ্টা করেই দেখি না!’’
অসীম জানান, দেড় বছর বয়সে ব্রজকিশোরের থেরাপি শুরু হয় ব্যান্ডেলের ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্রে’। সেখান থেকেই কানের যন্ত্র দেওয়া হয়। তত দিনে তাঁদের মেয়ে ওই কেন্দ্রের থেরাপির জোরেই সবে বাবা বলা শিখেছে। মেয়ে পারছে দেখে ভরসা বেড়ে যায় অসীমদের। ওই কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বেশ কিছু বছর ধরে আমরা এই কাজ করে চলেছি। এক সময়ে স্পষ্ট হয়, এই ধরনের ছেলেমেয়েদের যদিআলাদা ভাবে পড়াতে থাকি, তা হলে সমাজে ওঁদের গ্রহণযোগ্যতা কখনও তৈরি হবে না। তাই দরকার ওঁদের স্বাভাবিক স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করা। ব্রজকিশোর দেখিয়েছেন, সুযোগ দিলে মানুষ সব করতে পারে। আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষক হয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার হতে চলেছেন এই প্রথম।’’
প্রথম শ্রেণিতে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল ব্রজকিশোরকে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি বছর প্রথম হতে থাকে সে। এর পরে তাকে ভর্তি করানো হয় গলসি-২ ব্লকের গ্রামের খানু হাইস্কুলে। সেখানেও নবম শ্রেণি পর্যন্ত কিশোর ব্রজকিশোর প্রথম হতে থাকে বলে জানান বাবা অসীম। মাধ্যমিকের ভাল ফলের পরে ব্রজকিশোরকে ভর্তি করানো হয় গলসি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেও উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করেন ব্রজকিশোর। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর ডাক্তারি পড়ার পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি।
অসীম বলেন, ‘‘নবম ক্লাসের পরে শুধু ইংরেজির শিক্ষক দিতে পেরেছিলাম ছেলেকে। টেস্টের আগে ইতিহাস, ভূগোল এবং বাংলার জন্য সব মিলিয়ে এক জন শিক্ষক দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।’’
সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তেন ব্রজকিশোর। দুপুর পর্যন্ত পড়ে বিকেলে একটু বিশ্রাম। সন্ধ্যা ছ’টা থেকে ওঁর পড়া চলত রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত। এতেই ডাক্তারি পড়ার পরীক্ষায় ‘পার্সন উইথ ডিজ়এবিলিটি (পিডব্লিউডি) তালিকায় দেশের মধ্যে ওঁর নাম এসেছে ২০৬২ নম্বরে। রাজ্যের মধ্যে ব্রজকিশোরের নাম রয়েছে ১৪-তে।’’ গর্বিত বাবা এর পর বলেন, ‘‘নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুযোগ পাচ্ছিল। কিন্তু আমি চাই, ছেলে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেই থাকুক। আমি কাছে আছি, সময়-অসময়ে দেখতে পারব।’’
কথা শেষ করার মুহূর্তেই যেন চিন্তা ঘিরে ধরে অসীমকে। অস্ফুটে বলেন, ‘‘সাধারণ অনেক কিছুই আমার ছেলে ব্যবহার করতে পারে না। যেমন, অন্যেরা যে স্টেথো দিয়ে কাজ করবেন, তাতে ওর হবে না। ওর কানের যন্ত্রের সঙ্গে ব্লুটুথে যোগ করে দেওয়া যায়, এমন স্টেথো লাগবে। রক্তচাপ মাপারও আলাদা ধরনের যন্ত্র চাই ওর। এগুলোর দাম অনেক। ডাক্তারি পড়তেই তো অনেক টাকার ধাক্কা। আমি যা রোজগার করি, তাতে অসম্ভব।’’
তবে ব্রজকিশোর বলছেন, ‘‘আমার মতো সমস্যা যাঁদের, তাঁদের জন্য কাজ করব বলেই তো ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলাম। আমাকে পারতেই হবে।’’